আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায়: আসল সত্যিটা জানুন

গর্ভাবস্থায় প্রতিটি বাবা-মায়ের মনেই উঁকি দেয় একটি সাধারণ কৌতূহল - গর্ভের সন্তানটি ছেলে না মেয়ে? এই কৌতূহল মেটাতে অনেকেই আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বিভিন্ন লক্ষণ বা চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা…

Debolina Roy

 

গর্ভাবস্থায় প্রতিটি বাবা-মায়ের মনেই উঁকি দেয় একটি সাধারণ কৌতূহল – গর্ভের সন্তানটি ছেলে না মেয়ে? এই কৌতূহল মেটাতে অনেকেই আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থাকেন, বিভিন্ন লক্ষণ বা চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করেন। কিন্তু আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখে সত্যিই কি গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ বোঝা সম্ভব? আর এই কাজটি কি আইনত বৈধ? চলুন, এই বিষয়ে যাবতীয় তথ্য, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং আইনি দিকগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব আল্ট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে কীভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ করা হয়, এর নির্ভুলতার হার কতখানি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ভারত ও বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত আইন কী বলছে। পাশাপাশি, আমরা প্রচলিত কিছু ভুল ধারণারও অবসান ঘটাব।

আল্ট্রাসাউন্ডে লিঙ্গ নির্ধারণ: একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া

আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান বা আল্ট্রাসনোগ্রাম (USG) হলো একটি ইমেজিং পরীক্ষা যেখানে উচ্চ-কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি তৈরি করা হয়। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং সার্বিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পরীক্ষা।

গর্ভাবস্থার একটি নির্দিষ্ট সময়ে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ভ্রূণের যৌনাঙ্গ দেখে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে এটি কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল:

  • গর্ভাবস্থার সময়কাল (Gestational Age): ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য সময়ের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। গর্ভাবস্থার ১১-১৪ সপ্তাহের মধ্যে ‘স্যাজিটাল সাইন’ (Sagittal Sign) বা ‘নাব থিওরি’ (Nub Theory) নামক একটি পদ্ধতির মাধ্যমে লিঙ্গ সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
  • ভ্রূণের অবস্থান (Fetal Position): স্ক্যানের সময় ভ্রূণ যদি সঠিক অবস্থানে না থাকে, অর্থাৎ তার যৌনাঙ্গ যদি স্পষ্ট দেখা না যায়, তাহলে লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন বা অসম্ভব হতে পারে।
  • সোনোলজিস্টের অভিজ্ঞতা: যিনি আল্ট্রাসাউন্ড করছেন, তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
  • যন্ত্রের গুণমান: ব্যবহৃত আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের ছবির গুণমানও ফলাফলের উপর প্রভাব ফেলে।

স্যাজিটাল সাইন বা নাব থিওরি (The Nub Theory)

গর্ভাবস্থার ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই যৌনাঙ্গের গঠন প্রায় একই রকম থাকে, যাকে ‘জেনিটাল টিউবারকল’ (Genital Tubercle) বা ‘নাব’ (Nub) বলা হয়। এই ‘নাব’ মেরুদণ্ডের সাথে কী কোণে অবস্থান করছে, তার উপর ভিত্তি করে লিঙ্গ নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়।

  • ছেলে সন্তান: যদি ‘নাব’ টি মেরুদণ্ডের সাথে ৩০ ডিগ্রির বেশি কোণ করে উপরের দিকে নির্দেশ করে, তাহলে ছেলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • মেয়ে সন্তান: যদি ‘নাব’ টি মেরুদণ্ডের সমান্তরালে বা ১০ ডিগ্রির কম কোণে থাকে, তাহলে মেয়ে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নির্ভুলতার হার: গবেষণায় দেখা গেছে,

  • ১১ সপ্তাহে এই পদ্ধতির নির্ভুলতা প্রায় ৭০%।
  • ১২ সপ্তাহে নির্ভুলতা বেড়ে প্রায় ৯৮% হয়।
  • ১৩ সপ্তাহ বা তার পরে এই পদ্ধতির নির্ভুলতা প্রায় ১০০% এর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।

তবে ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে অ্যানোমালি স্ক্যানের (Anomaly Scan) সময় যৌনাঙ্গ পুরোপুরি গঠিত হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে স্পষ্টভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। এই সময়ে ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ এবং মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে ল্যাবিয়া (যোনিদ্বার) বা “হ্যামবার্গার সাইন” (তিনটি সমান্তরাল রেখা) দেখে লিঙ্গ শনাক্ত করা হয়।

আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট পড়ে কি লিঙ্গ বোঝা যায়?

একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, “রিপোর্টে কি এমন কিছু লেখা থাকে যা দেখে ছেলে না মেয়ে বোঝা যাবে?” এর সহজ উত্তর হলো – না

ভারত এবং বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ এবং তা প্রকাশ করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই কোনো রেজিস্টার্ড ডাক্তার বা সোনোলজিস্ট তাদের রিপোর্টে শিশুর লিঙ্গ সংক্রান্ত কোনো তথ্য উল্লেখ করেন না। রিপোর্টে F/O (Fetus of) বা Fetal শব্দের পর Male বা Female লেখা থাকে না। এর পরিবর্তে ভ্রূণের হার্টবিট (FHR), ওজন (EFW), বৃদ্ধি (BPD, HC, AC, FL) এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য উল্লেখ থাকে।

সুতরাং, রিপোর্টের কোনো সাংকেতিক চিহ্ন, সংক্ষিপ্ত রূপ বা সংখ্যা দেখে লিঙ্গ বোঝার চেষ্টা করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত আইন: ভারত ও বাংলাদেশ

নারী-পুরুষের অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা এবং কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো সামাজিক ব্যাধি রোধ করতে ভারত ও বাংলাদেশে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

  • ভারতে: ভারতে Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (PCPNDT) Act, 1994 আইন অনুযায়ী গর্ভধারণের আগে বা পরে লিঙ্গ নির্বাচন বা লিঙ্গ নির্ধারণ করা এবং তা প্রকাশ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইন লঙ্ঘন করলে ডাক্তার এবং রোগীর পরিবার উভয়েরই জেল ও জরিমানা হতে পারে।
  • বাংলাদেশে: বাংলাদেশেও গর্ভের শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করাকে উৎসাহিত করা হয় না। ২০২২ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত “লিঙ্গ লিঙ্গ ভিত্তিক যৌন নির্বাচনের উপর ভিত্তি করে প্রতিরোধ ও লিঙ্গ প্রতিরোধের জন্য জাতীয় নেতৃত্ব” (National Guideline for the Prevention of Son Preference and the Risk of Gender-Based Sex Selection) অনুযায়ী, অকারণে বা সামাজিক কারণে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ প্রকাশ না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য রোধ করা।

প্রচলিত ভুল ধারণা এবং বাস্তবতা

গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নিয়ে সমাজে অনেক পুরোনো ধারণা ও কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। যেমন:

  • পেটের আকার: পেট উঁচু হলে মেয়ে, আর নিচু হলে ছেলে – এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মায়ের শারীরিক গঠন, পেশীর দৃঢ়তা এবং শিশুর অবস্থানের উপর পেটের আকার নির্ভর করে।
  • হৃদস্পন্দনের হার (FHR): বলা হয়, ভ্রূণের হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে ১৪০ এর বেশি হলে মেয়ে এবং কম হলে ছেলে। এটিও একটি ভ্রান্ত ধারণা। শিশুর হৃদস্পন্দন তার বয়স এবং নড়াচড়ার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
  • খাবারের প্রতি আসক্তি: মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করলে মেয়ে, আর নোনতা বা টক খেতে ইচ্ছে করলে ছেলে – এরও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক।
  • মায়ের সৌন্দর্য: মায়ের সৌন্দর্য বাড়লে ছেলে, আর কমলে মেয়ে – এটিও একটি কুসংস্কার।

এই সমস্ত ধারণা শুধুমাত্র অনুমান এবং এর উপর বিশ্বাস করা উচিত নয়।

কেন লিঙ্গ নির্ধারণের উপর এত বিধিনিষেধ?

এর প্রধান কারণ হলো লিঙ্গ বৈষম্য এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা। অনেক সমাজেই পুত্র সন্তানের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। এর ফলে, গর্ভে কন্যা সন্তান আছে জানতে পারলে অনেকেই গর্ভপাত করানোর মতো চরম এবং অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সমাজে লিঙ্গ অনুপাতের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা নানান সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়।

একজন সুস্থ শিশুর জন্ম হওয়াই প্রতিটি বাবা-মায়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, সে ছেলে হোক বা মেয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর নির্দেশিকা অনুযায়ীও, প্রসবপূর্ব আল্ট্রাসাউন্ডের মূল উদ্দেশ্য হলো মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা, লিঙ্গ নির্ধারণ নয়।

উপসংহার

আল্ট্রাসাউন্ড একটি আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি যা গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। যদিও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গর্ভের শিশুর লিঙ্গ জানা সম্ভব, তবে সামাজিক ও নৈতিক কারণে এবং কঠোর আইনের উপস্থিতিতে তা প্রকাশ করা হয় না। আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখে সন্তানের লিঙ্গ বোঝার চেষ্টা করা নিরর্থক।

আসুন, আমরা কুসংস্কারে কান না দিয়ে একটি সুস্থ ও সুন্দর শিশুর আগমনের জন্য অপেক্ষা করি। ছেলে বা মেয়ে নির্বিশেষে প্রতিটি শিশুই মূল্যবান এবং সমান স্নেহের অধিকারী।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

প্রশ্ন: আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে কি লেখা থাকলে ছেলে বা মেয়ে বোঝা যায়?

উত্তর: আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে এমন কোনো নির্দিষ্ট শব্দ বা চিহ্ন লেখা থাকে না যা দেখে ছেলে বা মেয়ে বোঝা সম্ভব। ভারত ও বাংলাদেশে আইনত লিঙ্গ প্রকাশ নিষিদ্ধ হওয়ায় রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখ করা হয় না।

প্রশ্ন: কত সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড করলে লিঙ্গ সবচেয়ে নির্ভুলভাবে বোঝা যায়?

উত্তর: গর্ভাবস্থার ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে অ্যানোমালি স্ক্যানের সময় ভ্রূণের যৌনাঙ্গ স্পষ্ট দেখা যায় এবং তখন লিঙ্গ সবচেয়ে নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।

প্রশ্ন: ‘নাব থিওরি’ (Nub Theory) কতটা নির্ভরযোগ্য?

উত্তর: ‘নাব থিওরি’ একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, তবে এর নির্ভুলতা গর্ভাবস্থার সময়ের উপর নির্ভরশীল। ১২-১৩ সপ্তাহে এর নির্ভুলতা অনেক বেশি, তবে এর আগেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

প্রশ্ন: গর্ভের বাচ্চার হার্টবিট দেখে কি লিঙ্গ বোঝা যায়?

উত্তর: না, এটি একটি প্রচলিত ভুল ধারণা। বাচ্চার হৃদস্পন্দনের হারের সাথে তার লিঙ্গের কোনো বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নেই।

প্রশ্ন: ভারতে বা বাংলাদেশে কি গর্ভের শিশুর লিঙ্গ জানা আইনত বৈধ?

উত্তর: না। ভারতে PCPNDT Act, 1994 অনুযায়ী এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশেও শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য কঠোর সরকারি নির্দেশনা রয়েছে।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।