বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর)। শুক্রবার (১৮ জুলাই ২০২৫) জেনেভা থেকে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিন বছর মেয়াদি এই মিশন স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এবং জাতিসংঘের পক্ষে মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) উপদেষ্টা পরিষদের ৩৩তম বৈঠকে এই মিশন স্থাপনের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই ১৬টি দেশের তালিকায় যুক্ত হলো, যেখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ পূর্ণাঙ্গ ম্যান্ডেট নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ নিশ্চিত করতেই এই মিশন স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সহিংস দমনপীড়নের ঘটনাগুলো নিয়ে জাতিসংঘ বিস্তৃত তথ্য-অনুসন্ধান চালিয়েছে।
পৃথিবীতে এখনো ১৭টি দেশ স্বাধীন নয় – জানুন কোন কোন দেশগুলি এখনো উপনিবেশ!
মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এই মিশন চালুর গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, “রূপান্তরের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার যে ভিত্তি হিসেবে রয়েছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ বার্তাই মিশন চালুর বিষয়ে এই সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্য দিয়ে এসেছে।” তিনি আরও জানান, এই মিশন তাদের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদানে কাজ করবে।
নতুন এই মানবাধিকার মিশন তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে। প্রথমত, পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা সংস্কারে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মানবাধিকার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হবে।
দ্বিতীয়ত, পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্টিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে। এই প্রতিবেদনগুলো জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থায় উপস্থাপন করা হবে। তৃতীয়ত, সচেতনতা ও অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে এনজিও, সিভিল সোসাইটি ও সাংবাদিকদের সাথে কাজ করে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো হবে।
তবে এই মিশনের কোনো আইন প্রয়োগকারী ক্ষমতা থাকবে না। এটি সুপারিশ ও সংলাপের মাধ্যমে পরিবর্তনের চেষ্টা চালাবে বলে জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, এই কার্যালয় কোনো ‘হস্তক্ষেপমূলক’ সংস্থা নয়। এটি সরকারের অনুমোদিত একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে এবং সব কাজ সরকার ও জাতিসংঘের সম্মতিতে পরিচালিত হবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানান ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২ জন ব্যক্তি জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্নমতাবলম্বীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সুরক্ষায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের ৮০টিরও বেশি দেশে প্রায় ৯০টি মাঠপর্যায়ের অফিস রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, কলম্বিয়া, সুদান, ফিলিপাইন, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, দক্ষিণ সুদান, ইউক্রেন ও সিরিয়ার মতো দেশে। এসব কার্যালয় সংশ্লিষ্ট দেশে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও সহায়তার কাজ করে থাকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের সার্বজনীন সুবিধাভোগের প্রসার, মানবাধিকার ইস্যুতে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার চর্চায় গুরুত্বারোপ করা। এছাড়া মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনে প্রতিক্রিয়া জানানো ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণও এর অন্যতম দায়িত্ব।
তবে এই মিশন স্থাপনে সবাই একমত নন। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এই উদ্যোগে ‘গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা’ প্রকাশ করেছে। দলটি ঘোষণা দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় খুলতে দেবে না। কিছু সমালোচক মনে করেন, এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি নজরদারিমূলক বার্তা হতে পারে।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ বজায় রাখা, জিএসপি সুবিধা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির বিবেচনায় এই মিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশনের এই কার্যক্রম দেশটির গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও মানবাধিকার সুরক্ষায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তিন বছর মেয়াদি এই মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনের পথ সুগম হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।