ভারতের বিস্তৃত উপকূলরেখা এবং দ্বীপপুঞ্জগুলি স্কুবা ডাইভারদের জন্য এক অপার সম্ভাবনার জগৎ উন্মুক্ত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এই দেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পর্যটন শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। আসুন, একজন অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের সেরা স্কুবা ডাইভিং গন্তব্যগুলি অন্বেষণ করি।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কুবা ডাইভিং গন্তব্য। এখানকার স্বচ্ছ জল, বৈচিত্র্যময় প্রবাল প্রাচীর এবং সমৃদ্ধ সামুদ্রিক জীবন ডাইভারদের মুগ্ধ করে।
হাভলক দ্বীপ, যা বর্তমানে স্বরাজ দ্বীপ নামে পরিচিত, এর এলিফ্যান্ট বীচ বিশ্বের অন্যতম সেরা স্কুবা ডাইভিং স্পট। এখানে ‘দ্য ওয়াল’ নামক একটি বিখ্যাত ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি 100 ফুট পর্যন্ত গভীরতায় নামতে পারেন। এখানে নীল ফিনড ট্যুনা, জায়ান্ট ট্রেভালি, এবং বিভিন্ন প্রজাতির শার্ক দেখা যায়।
নিল দ্বীপে রয়েছে ‘ম্যার্জি নেস্ট’, যা একটি অসাধারণ ডাইভ সাইট। এখানে 40 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামা যায় এবং বড় পেলাজিক মাছ, মান্তা রে এবং বিভিন্ন প্রজাতির শার্ক দেখা যায়।
বারাটাং দ্বীপের কাছে অবস্থিত ‘ফিশ রক’ একটি জনপ্রিয় ডাইভ স্পট। এখানে বিশাল গরগোনিয়ান ফ্যান কোরাল এবং বৈচিত্র্যময় নাডিব্রাঙ্ক দেখা যায়। এছাড়া, এখানে ব্ল্যাক-টিপ রিফ শার্ক এবং হোয়াইট-টিপ রিফ শার্কও দেখা যায়।
লাক্ষাদ্বীপ ভারতের একমাত্র প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ, যা এর অনন্য সামুদ্রিক পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। এখানকার স্বচ্ছ জল এবং বৈচিত্র্যময় প্রবাল প্রাচীর স্কুবা ডাইভারদের জন্য স্বর্গরাজ্য।
বাংগারাম দ্বীপ লাক্ষাদ্বীপের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কুবা ডাইভিং গন্তব্য। এখানে ‘দ্য ওয়াল অফ ওয়ান্ডার’ নামক একটি বিখ্যাত ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে 40 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামা যায়। এখানে নাপোলিয়ন রেস, ইয়েলো-ফিন ট্যুনা এবং গ্রে রিফ শার্ক দেখা যায়।
কাদমাত দ্বীপে রয়েছে ‘শার্ক জাংশন’, যেখানে আপনি গ্রে রিফ শার্ক, হোয়াইট টিপ শার্ক এবং সিল্ভার টিপ শার্ক দেখতে পারেন। এছাড়া, এখানে বিশাল মান্তা রে-ও দেখা যায়।
আগাত্তি দ্বীপের কাছে রয়েছে ‘দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’, যা একটি অসাধারণ ডাইভ সাইট। এখানে 30 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামা যায় এবং বিভিন্ন প্রজাতির ট্যুনা, বারাকুডা এবং ইগল রে দেখা যায়।
গোয়া শুধুমাত্র এর সৈকত এবং নাইটলাইফের জন্যই নয়, এর অসাধারণ স্কুবা ডাইভিং অভিজ্ঞতার জন্যও বিখ্যাত।
গ্র্যান্ড আইল্যান্ড গোয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ডাইভিং স্পট। এখানে ‘সেইলফিশ রিফ’ নামক একটি বিখ্যাত ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি 30 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামতে পারেন। এখানে লাইন্ট ফিশ, স্নেপার এবং গ্রুপার দেখা যায়।
বাটা রিফ গোয়ার আরেকটি জনপ্রিয় ডাইভ স্পট। এখানে ‘উমা গুহা’ নামক একটি অসাধারণ ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির মোরে ইল এবং লিওপার্ড শার্ক দেখতে পারেন।
সুরজ বার রিফে রয়েছে ‘দেবদূত রিফ’, যেখানে আপনি বিশাল জিয়ান্ট গ্রুপার এবং হানিকম মোরে দেখতে পারেন। এছাড়া, এখানে একটি পুরোনো পর্তুগিজ জাহাজের ধ্বংসাবশেষও রয়েছে।
পণ্ডিচেরী, যা বর্তমানে পুদুচেরী নামে পরিচিত, ভারতের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এটি তার ফরাসি ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু এখানে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্যও বেশ কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
আরাম্বম রিফ পুদুচেরীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ডাইভিং স্পট। এখানে ‘দ্য ফোর কর্নারস’ নামক একটি বিখ্যাত ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি 25 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামতে পারেন। এখানে লাইনর্টফিশ, স্নেপার এবং গ্রুপার দেখা যায়।
কোভালাম বীচের কাছে রয়েছে ‘টেম্পল রিফ’, যেখানে আপনি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পারেন। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির বাটারফ্লাই ফিশ এবং এঞ্জেলফিশ দেখা যায়।
মাদ্রাস হাই কোর্ট রিফ একটি কৃত্রিম রিফ, যা 2018 সালে তৈরি করা হয়েছিল। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির কোরাল এবং রিফ ফিশ দেখা যায়।
গুজরাট ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি রাজ্য, যা এর ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। তবে, এখানে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্যও কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
দ্বারকা, যা হিন্দু ধর্মে একটি পবিত্র শহর হিসেবে পরিচিত, এখানে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। ‘শ্রী দ্বারকাধীশ টেম্পল সাইট’ নামক একটি ডাইভ স্পট রয়েছে, যেখানে আপনি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পারেন।
পিরাম দ্বীপের কাছে রয়েছে ‘পিরাম রিফ’, যেখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির কোরাল এবং রিফ ফিশ দেখতে পারেন। এখানে 20 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামা যায়।
বেট দ্বারকায় রয়েছে ‘ওকা রিফ’, যেখানে আপনি দোলফিন এবং পর্পোইজ দেখতে পারেন। এছাড়া, এখানে বিভিন্ন প্রজাতির রিফ ফিশও দেখা যায়।
মহারাষ্ট্র ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি রাজ্য, যা এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য কিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে।
মালভান মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কুবা ডাইভিং গন্তব্য। এখানে ‘সিন্ধুদুর্গ ফোর্ট’ নামক একটি বিখ্যাত ডাইভ সাইট রয়েছে, যেখানে আপনি প্রাচীন কিল্লার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পারেন। এখানে 15 মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নামা যায়।
তারকারলি বীচের কাছে রয়েছে ‘কোরাল গার্ডেন’, যেখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির সফট কোরা
তারকারলি বীচের কাছে রয়েছে ‘কোরাল গার্ডেন’, যেখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির সফট কোরাল এবং হার্ড কোরাল দেখতে পারেন। এখানে 10-15 মিটার গভীরতায় নামা যায় এবং অনেক রঙিন ট্রপিক্যাল ফিশ দেখা যায়।
স্কুবা ডাইভিং একটি আনন্দদায়ক অ্যাডভেঞ্চার হলেও, নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সমস্ত প্রধান ডাইভিং কেন্দ্রগুলি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলে এবং প্রশিক্ষিত ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ করে।
ভারত সরকার সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। 2019 সালে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় কোরাল রিফ সংরক্ষণের জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এই পরিকল্পনায় কোরাল রিফের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক জীবন এবং অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য একটি আদর্শ গন্তব্য হয়ে উঠেছে ভারত। আন্দামান থেকে লাক্ষাদ্বীপ, গোয়া থেকে মহারাষ্ট্র – প্রতিটি স্থান নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং আকর্ষণ নিয়ে ডাইভারদের স্বাগত জানায়। তবে, এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। দায়িত্বশীল ডাইভিং অনুশীলন এবং পরিবেশ সচেতনতার মাধ্যমে, আমরা এই অমূল্য সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি।
ভারতের স্কুবা ডাইভিং শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। সরকারি উদ্যোগ এবং বেসরকারি বিনিয়োগের ফলে এই খাতে ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। নতুন ডাইভ স্পট আবিষ্কার, উন্নত সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি বর্ধিত মনোযোগ – এসব ভারতকে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্কুবা ডাইভিং গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করছে।