Rath Yatra 2024: ভক্তিতে ভাসমান লক্ষ লক্ষ মানুষের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর, রথের চাকার ঘর্ঘর শব্দ আর ঢাকের বাদ্যে মুখরিত পুরীর আকাশ-বাতাস। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে এমনই এক অপূর্ব দৃশ্যের সাক্ষী থাকে ভারতের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান পুরী। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব রথযাত্রা শুধু ভারতের নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রথ উৎসব হিসেবে স্বীকৃত। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই বিশাল উৎসব সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য যা আপনাকে অবাক করে দেবে।
রথযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য
রথযাত্রার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। হিন্দু পুরাণগুলিতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ এবং কপিল সংহিতায় রথযাত্রার বর্ণনা রয়েছে। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়।রথযাত্রার মূল তাৎপর্য হল ভগবান জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাকে তাঁদের মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া। এই যাত্রা প্রতীকী অর্থে ভগবানের সাথে ভক্তের মিলনকে বোঝায়। ভক্তরা রথের রশি ধরে টানার মাধ্যমে ভগবানকে নিজেদের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করেন।
রথযাত্রার অজানা তথ্য
১. তিনটি বিশাল রথ: জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার জন্য তিনটি আলাদা রথ তৈরি করা হয়। জগন্নাথের রথের নাম নন্দিঘোষ, বলরামের রথের নাম তালধ্বজ এবং সুভদ্রার রথের নাম দেবদলন।
২. রথের বিশাল আকার: জগন্নাথের রথ নন্দিঘোষ সবচেয়ে বড়। এর উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট এবং ১৮টি চাকা রয়েছে। বলরামের রথ তালধ্বজের উচ্চতা ৪৪ ফুট এবং ১৪টি চাকা রয়েছে। সুভদ্রার রথ দেবদলনের উচ্চতা ৪৩ ফুট এবং ১২টি চাকা রয়েছে।
৩. রথ নির্মাণের জটিল প্রক্রিয়া: প্রতি বছর নতুন করে রথ তৈরি করা হয়। রথ নির্মাণে প্রায় ২ মাস সময় লাগে। জগন্নাথের রথ তৈরিতে ২০৬টি কাঠের লগ ব্যবহার করা হয়।
৪. রথের রঙিন সাজসজ্জা: রথগুলি বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। জগন্নাথের রথে লাল ও হলুদ, বলরামের রথে লাল ও সবুজ এবং সুভদ্রার রথে লাল ও কালো রঙের কাপড় ব্যবহার করা হয়।
৫. দৈত্য পতি সেবা: রথযাত্রার সময় দৈত্য পতি নামে পরিচিত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরা দেবতাদের সেবা করেন। এরা মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক যারা প্রাচীনকাল থেকে এই অধিকার পেয়ে আসছেন।
৬. ডাহুক বোলি: রথযাত্রার সময় ডাহুক নামে পরিচিত একদল লোক বিশেষ ধরনের গান গায় যা ডাহুক বোলি নামে পরিচিত। এই গানগুলি অশ্লীল হলেও ঐতিহ্যগতভাবে গ্রহণযোগ্য।
৭. চৈতন্য মহাপ্রভুর ভূমিকা: ১৬ শতকে চৈতন্য মহাপ্রভু রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর ভক্তিভাবে মুগ্ধ হয়ে অনেক লোক এই উৎসবে যোগ দেন। এর ফলে রথযাত্রার জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে যায়।
৮. সুনা বেশা: রথযাত্রার ৯ দিন পর দেবতাদের সোনার অলংকারে সাজানো হয়। এই অনুষ্ঠানকে সুনা বেশা বলা হয়। এই সময় দেবতাদের গায়ে প্রায় ২০৮ কেজি সোনার অলংকার পরানো হয়।
৯. হেরা পঞ্চমী: রথযাত্রার পঞ্চম দিনে হেরা পঞ্চমী উৎসব পালিত হয়। এই দিন দেবী লক্ষ্মী জগন্নাথকে খুঁজতে গুণ্ডিচা মন্দিরে যান।
১০. বানাতি শিল্প: রথযাত্রার সময় বানাতি নামে একটি বিশেষ শিল্প প্রদর্শিত হয়। এতে শিল্পীরা আগুনের বল ঘোরান যা দর্শকদের মুগ্ধ করে।
১১. ২০২৪ সালের বিশেষত্ব: ২০২৪ সালে রথযাত্রা দুই দিন ধরে চলবে। ৭ জুলাই বিকেলে শুরু হবে এবং ৮ জুলাই সকালে শেষ হবে। এর আগে ১৯৭১ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল।
১২. বিশ্বব্যাপী উদযাপন: শুধু পুরীতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রথযাত্রা উদযাপিত হয়। ইসকন মন্দিরগুলি বিশ্বব্যাপী এই উৎসব পালন করে থাকে।
১৩. স্নান যাত্রা: রথযাত্রার প্রায় দুই সপ্তাহ আগে স্নান যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন দেবতাদের ১০৮ কলসী জল দিয়ে স্নান করানো হয়।
Economics as a Subject: অর্থনীতির শিক্ষা সুযোগ, ক্যারিয়ার সম্ভাবনা [ এক নজরে ]
রথযাত্রার সময় কোন দেবতাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়
রথযাত্রার সময় জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা দেবতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই যাত্রাকে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া বলা হয়।বিস্তারিত তথ্য:
১. তিন দেবতা: জগন্নাথ, তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রাকে রথযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়।
২. গন্তব্য: দেবতাদের গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়, যা জগন্নাথের মাসির বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
৩. যাত্রার দূরত্ব: জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা মন্দির পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করা হয়।
৪. সময়কাল: দেবতারা গুণ্ডিচা মন্দিরে এক সপ্তাহ অবস্থান করেন।
৫. প্রতীকী অর্থ: এই যাত্রা প্রতীকীভাবে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি যাওয়া হিসেবে পরিচিত।
৬. রথের বিবরণ: প্রতিটি দেবতার জন্য আলাদা রথ ব্যবহার করা হয়। জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ, বলরামের রথের নাম তালধ্বজ এবং সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন।
৭. ভক্তদের অংশগ্রহণ: লক্ষ লক্ষ ভক্ত রথের রশি ধরে টেনে দেবতাদের গুণ্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যান
রথযাত্রা উৎসবে কোন বিশেষ খাবার গ্রহণ করা হয়
রথযাত্রা উৎসবে কয়েকটি বিশেষ খাবার গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
১. জিলিপি: রথযাত্রার দিনে জিলিপি খাওয়ার একটি বিশেষ প্রথা রয়েছে। এটি উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিচিত।
২. পাঁপড় ভাজা: জিলিপির সাথে পাঁপড় ভাজাও রথযাত্রার দিনে খাওয়া হয়। এটি মূলত উত্তর ভারতের একটি বিখ্যাত খাবার হলেও রথযাত্রার সময় বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
৩. খিচুড়ি: রথযাত্রার দিনে জগন্নাথদেবকে খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয়। বিশেষ করে কর্মবাই খিচুড়ি নামে একটি বিশেষ ধরনের খিচুড়ি তৈরি করা হয়।
৪. কনিকা পুলাও: এটিও জগন্নাথদেবের প্রিয় ভোগের অন্যতম।
৫. ডালমা: পুরীর মন্দিরের বিখ্যাত ভোগের খাবার ডালমা, যা রথযাত্রার সময় বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়।
৬. মহাপ্রসাদ: জগন্নাথ মন্দিরে দিনে ছয়বার মহাপ্রসাদ তৈরি করা হয়। এতে সাত রকমের ভাত, চার রকমের ডাল, নয় রকমের সবজি এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৭. মিষ্টি: রথযাত্রার ভোগে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি তৈরি করা হয়, যেখানে চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করা হয়।এছাড়াও উল্লেখ করা যায় যে, রথযাত্রার সময় মোট ৫৬ প্রকারের ভোগ প্রস্তুত করা হয় জগন্নাথদেবের জন্য। এই সমস্ত খাবার রথযাত্রা উৎসবকে আরও সমৃদ্ধ ও স্বাদুপূর্ণ করে তোলে।
জিলিপি ও পাঁপড় কেন রথযাত্রার দিনে খেতে হয়
১. ঐতিহ্যগত কারণ:
- দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিরা রথযাত্রার দিনে জিলিপি ও পাঁপড় খাওয়ার রীতি পালন করে আসছে। এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
২. ধর্মীয় তাৎপর্য:
- কিংবদন্তি অনুযায়ী, জিলিপি ছিল ভগবান রামের প্রিয় মিষ্টি। হনুমান নিজে রামের জন্য জিলিপি তৈরি করতেন।
- প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে উপবাসের পর বেসনের তৈরি মিষ্টি খাওয়া উচিত। জিলিপি বেসন দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টি।
৩. স্বাস্থ্যগত কারণ:
- রথযাত্রার সময় আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়। এই সময় জিলিপি খাওয়া মাইগ্রেন প্রতিরোধে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।
- দুধের সাথে জিলিপি খেলে সর্দি-কাশির ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে কাজ করে।
৪. উৎসবের আনন্দ:
- মিষ্টি জিলিপি ও ক্রিস্পি পাঁপড় উৎসবের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে।
- রথযাত্রার মেলায় এই দুটি খাবার সহজলভ্য হয় বলে অনেকেই এগুলি খেতে পছন্দ করে।
৫. নস্টালজিয়া:
- অনেকের ছোটবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে রথযাত্রার দিনে জিলিপি ও পাঁপড় খাওয়ার সাথে।
তাই ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত কারণে রথযাত্রার দিনে জিলিপি ও পাঁপড় খাওয়ার রীতি বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
রথযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও পর্যটক এই উৎসবে যোগ দিয়ে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেন। রথযাত্রার মাধ্যমে মানুষ শুধু ভগবানের সান্নিধ্যই পায় না, পায় এক অনাবিল আনন্দ ও শান্তি। আসুন, আমরাও এই মহান ঐতিহ্যকে সম্মান জানাই এবং এর মাধ্যমে নিজেদের জীবনে সত্য, শিব ও সুন্দরের সন্ধান করি।