মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, তুর্কি আক্রমণের পরে লৌকিক দেবদেবীর গুরুত্ব বেড়েছিল। সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেবী চণ্ডী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। ষোড়শ শতকের আগে থেকেই বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের যে ধারার সূচনা হয় তা সার্থকতার স্তরে উন্নত হয়েছিল চৈতন্য আবির্ভাবের পরে। সাহিত্য সমালোচকরা বিজয়গুপ্ত, নারায়নদেব প্রমুখ কবিদের কাব্যে খুঁজে পেয়েছেন নানা অসম্পূর্ণতা। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সপ্তদশ শতকে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের আবির্ভাব। মঙ্গলকাব্যধারায় তিনি নিয়ে এলেন এক নিটোল কাহিনী বিন্যাসের ছবি।
যদিও কেতকাদাসের হাত ধরে কাব্যিক সম্পূর্ণতা লাভ করার আগে রাঢ় বাংলার নানা জায়গায় লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল মনসামঙ্গল কাব্য। বর্ধমান জেলায় নানা লোকশ্রুতিতে নজর দিলে দেখা যায়, বর্ধমান যেন মনসামঙ্গলের কাহিনীকে আত্মস্থ করার প্রয়াস নিয়েছে।
কেতকাদাসের কাব্যে বেহুলার যাত্রাপথের যে বর্ণনা রয়েছে তাতে রাঢ় বাংলার নদী নালা থেকে শুরু করে পরিবেশের যে বর্ণনা রয়েছে, বর্ধমান জেলার মানুষ চাঁদ সদাগরের ভূমি হিসেবে যে নির্দিষ্ট জায়গাটিকে আবহমানকাল ধরে দাবি করে আসছে তা যেন একই মনে হয়।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার পানাগড় থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিনে, দামোদর নদের উত্তর তীরে রয়েছে এই স্থান। লোকমুখে এই স্থানের নাম চম্পকনগর। স্থানীয়দের দাবি, এটি আসলে চাঁদ সদাগরের চম্পকনগর। এই দাবি সত্য অথবা অসত্য তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে তবে এখানে আলোচ্য বিষয় সেটি নয়।
বুদবুদ থেকে কসবা হয়েও পৌঁছানো যায় চম্পকনগরে। এখানে অতি প্রাচীন শিবমন্দির ছিল। এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। কথিত আছে, শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং চাঁদ সদাগর। প্রাচীন শিবমন্দিরটি সংস্কার করে নবরূপ দান করা হয়েছে। অনেকগুলি সিঁড়ি পেরিয়ে উঁচু ঢিবির উপরে অবস্থিত মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরে রয়েছে ছয় ফুট উচ্চতা ছয়টি কোণবিশিষ্ট শিবলিঙ্গ।
শব্দের জাদুকর: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি
এই শিবলিঙ্গের পাশ দিয়ে গেলে পড়বে বিরাট বেল গাছ। সেই বেল গাছের একেবারে কোনে পড়বে আরেকটি শিবলিঙ্গ। এই শিবলিঙ্গটির বিশেষত্ব হলো, শিবলিঙ্গের মাথাটি নেই। জনশ্রুতি অনুসারে, কালাপাহাড় নাকি শিবলিঙ্গের মুন্ডচ্ছেদ করেছিলেন। এখান থেকেই নজর যায় একটি উঁচু টিলার দিকে। কথিত রয়েছে এটি নাকি লখিন্দরের বাসরঘর।
কাহিনী অনুসারে, বাসর রাতে সর্পদংশনে প্রাণ হারানোর কথা ছিল লখিন্দরের। সে বিপদ থেকে বাঁচতে চাঁদ সদাগর তৈরি করেছিলেন লোহার বাসর ঘর।
স্থানীয়রা বলছেন, বহুদিন আগে এলাকায় খননকার্য চালাতে গিয়ে তিন কুঠুরি বিশিষ্ট এই ঘরটি নজরে আসে। যদিও ঘরটি লোহার নয়, ইট দিয়ে নির্মিত। কিন্তু দূর থেকে দেখলে লোহা বলে ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটু কালচে রং তাই দূর থেকে মনে হয় যেন জং ধরা লোহা। এই ঘরের পাশ দিয়ে টিলা বরাবর আরেকটু উঁচুতে উঠলে পাওয়া যাবে একটি মনসা মন্দির।
শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রতিবছর এখানে মেলা বসে। শ্রাবণের সংক্রান্তিতে ভিড় জমান মানুষ। শৈব সম্প্রদায় এবং মনসা উপাসক মানুষের সহাবস্থান দেখা যায় এই অঞ্চলে।
এখন প্রশ্ন কিভাবে এখানে পৌঁছানো যাবে? যদি কলকাতা বা দুর্গাপুর থেকে আসেন তাহলে জাতীয় সড়ক হয়ে আপনাকে প্রথমে আসতে হবে পানাগড়। পানাগড় থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন চম্পকনগরে। স্থানীয়দের দাবি ঠিক না ভুল সে প্রসঙ্গ ভিন্ন তবে শান্ত নির্জন পরিবেশে আপনি হয়তো অনুভব করতে পারবেন বেহুলার দুঃখের কথা অথবা লখিন্দরের প্রতি তার প্রেমে অবগাহনের দিনলিপি।
মন্তব্য করুন