ভারতে ক্রিকেট যদি ধর্ম হয়, তাহলে সেই ধর্মের ঈশ্বর হলেন শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ১৬ বছর বয়সে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, কোঁকড়া চুলের এই ছেলেটিকে দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি যে, বিনয়ী চেহারার এই ছেলেটি পরবর্তীতে ক্রিকেটের রাজা বলে সম্বোধন করা হবে। আজও অনেক ছেলে প্রতিদিন ক্রিকেট খেলে এই ভেবে যে তারা পরে শচীন টেন্ডুলকার হবে।
১৯৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেট মাঠে এত রেকর্ড গড়েছেন যে এক জন্মে কারও পক্ষে ভাঙা সম্ভব নয়। শচীন ক্রিকেট বিশ্বের অমূল্য রত্ন একথা বলাই বাহুল্য, যার সম্মানে বড় পুরস্কারও যেন ম্লান হয়ে যায়। রাজীব গান্ধী খেলরত্ন, পদ্মবিভূষণ এবং ভারতরত্নের মতো সম্মানে সম্মানিত শচীন তাঁর জীবনে একের পর এক রেকর্ড গড়েছেন। শচীনের মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের হয়ে ওঠার যাত্রাও বেশ আকর্ষণীয়।
চলুন জেনে নেয়া যাক তাঁর জীবনের কিছু মজার তথ্য:
১৬ বছর বয়সে শুরুঃ
শচীন রমেশ টেন্ডুলকার এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন যিনি কেবল ক্রিকেটে তার সময়কালে পুরো বিশ্বে ক্রিকেটের ঈশ্বরও হয়েছিলেন। ১৬ বছর ২০৫ দিন বয়সে ১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় শচীনের। সেই ম্যাচটি করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেটে খেলা হয়েছিল সেই ম্যাচে শচীন ২৪ বল খেলেন এবং যেখানে তিনি ১৫ রান করেছিলেন এবং ওয়াকার ইউনিসের বলে বোল্ড হন।
বোলার হতে চেয়েছিলেন শচীন:
শচীনের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন ঔপন্যাসিক। তিনি তার প্রিয় সংগীতশিল্পী শচীন দেববর্মণের নামে তার ছেলের নাম রেখেছিলেন। বড় ভাই অজিত তেন্ডুলকার তাকে খেলতে উৎসাহিত করেন। শচীনের এক ভাই নীতিন টেন্ডুলকার এবং একটি বোন সবিতা তেন্ডুলকর রয়েছে। সচিনের দুই সন্তান, মেয়ে সারা ও ছেলে অর্জুন। ১১ বছর বয়সে প্রথমবার ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধরেন শচীন। রঞ্জি ট্রফি ও দিলীপ ট্রফির অভিষেকে প্রথম সেঞ্চুরি করা খেলোয়াড় তিনি। শচীন ব্যাটসম্যান নয়, ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু ১৯৮৭ সালে চেন্নাইয়ের এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ তার উচ্চতা কম ছিল। না হলে আজ বোলিংয়ে নতুন রেকর্ড গড়তেন মাস্টার ব্লাস্টার শচীন।
অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন:
সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড শচীনের দখলে। শচীন তার টেস্ট সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন ছয়টি ছক্কা মেরে। শুধু তাই নয়, শচীনের সর্বশেষ অর্থাৎ ৫১তম টেস্ট হাফসেঞ্চুরিও ২০১১ সালের জানুয়ারিতে কেপটাউনে মরনে মরকেলের বলে করেন।
কোচরা মজার ছলে অনুশীলন করতেন:
জানলে অবাক হবেন, সচিন যখন তাঁর কোচের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতেন। তাঁর কোচ স্টাম্পে এক টাকার কয়েন লাগিয়ে দিতেন, যে বোলার শচীনকে আউট করতেন সেই কয়েনটা পেতেন। শচীন যদি আউট না হয়ে পুরোটা সময় ব্যাটিংয়ে সফল হতেন, তাহলে এই মুদ্রা যেত শচীনের হাতে। সচিনের কাছে আজও ১৩টি এরকম মুদ্রা রয়েছে।
শচীন বরাপাও ভক্ত:
সারা বিশ্বে নিজের ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়া শচীন টেন্ডুলকার খাওয়া-দাওয়ার দিক থেকে একেবারে সাধারণ ভারতীয়। মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া শচীনের প্রিয় খাবারও মহারাষ্ট্রীয় খাবার। তিনি বড়াপাও কে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে মুম্বইয়ের দাদরের বরাপাও তাঁর খুব পছন্দের, তাও আবার শিবাজি পার্কের বাইরে, সচিন যখন ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতেন, তখন বড়াপের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
রেকর্ডের নিরিখে শচীনের চেয়ে এগিয়ে নেই কেউই:
শচীন টেন্ডুলকারকে বিনা কারণে ক্রিকেটের রাজা বলা হয় না। ২৪ বছরের কেরিয়ারে অসংখ্য রেকর্ড গড়েছেন শচীন। এক জন্মে কেউ তা ভাঙতে পারে না। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে ১০০টি সেঞ্চুরি করেছেন শচীন। ৪৯টি ওয়ানডে ও ৫১টি টেস্ট ক্রিকেটে রয়েছেন তিনি।
খারাপ ফর্মেও মনোবল হারাননি:
ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে কোনও খেলোয়াড় ধারাবাহিকভাবে ভাল পারফর্ম করতে পারে না। শচীনের জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল যখন নিজের বাজে ফর্মের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। শচীন টেন্ডুলকার ৯০ থেকে ৯৯ রানের মধ্যে প্রায় ২০ বার আউট হয়েছিলেন। যতবারই হতাশ হয়ে মাঠ থেকে ফিরেছেন, ততবারই নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছেন তিনি। তার খারাপ সময়কে পরাস্ত করার জন্য, তিনি ধারাবাহিকভাবে খেলতে থাকেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে, শচীন তেন্ডুলকর তার ওয়ানডে ক্রিকেটের ৪৪২তম ম্যাচে ২০০ রান করে একটি ঐতিহাসিক ইনিংস খেলেন, এটি ছিল বিশ্ব ক্রিকেটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
ওয়ানডেতে ১৮ হাজারের বেশি রানের রেকর্ড শচীনের দখলে। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার ম্যান অব দ্য সিরিজ ও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন শচীন। আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ৩০ হাজার রানের মালিক শচীন টেন্ডুলকারের দখলে। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বিপক্ষে শততম সেঞ্চুরি করেন তিনি। তাঁর সেঞ্চুরির অপেক্ষায় ছিল গোটা বিশ্ব।
অবসরের সময় প্রতিপক্ষের চোখও ছিল অশ্রুসিক্ত:
শচীন টেন্ডুলকার যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন, তখন প্রতিপক্ষের চোখে ছিল অশ্রু । অবসরের আগে শচীনের স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতা। তাঁর স্বপ্ন পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ২০১১ সালের ২ এপ্রিল শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে ভারত তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় করে। শচীনের জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল যখন নিজের বাজে ফর্মের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি।
সচিনের এই অভ্যাসটা খেয়াল করেছেন তো?
আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, নতুন রেকর্ড তৈরি করে শচীন মাথা তুলে চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। শচীন নিজেই জানিয়েছেন এ সম্পর্কে। তারা উপরের আকাশে সূর্য দেবতাকে প্রণাম করে। প্রতিটি রেকর্ড গড়ার পর নিজের হেলমেটে তেরঙ্গায় চুমু খান।
সবচেয়ে বড় সম্মান পেয়েছেন শচীন:
ক্রিকেট বিশ্বের সব পুরস্কারই দখল করে নিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার। এর পাশাপাশি তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে সম্মানিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০১৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন শচীন রমেশ তেন্ডুলকর। ভারতরত্ন ছাড়াও শচীন ১৯৯৪ সালে অর্জুন পুরস্কার, ১৯৯৭-৯৮ সালে রাজীব গান্ধী খেলরত্ন, ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে মহারাষ্ট্রভূষণ পুরস্কার, ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হন