Why is Muharram observed: ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহরম – একটি নাম যা শুনলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অনুভূতি জাগে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমান এই পবিত্র মাসটি পালন করেন বিশেষ ভক্তি ও সম্মানের সাথে। কিন্তু আপনি কি জানেন, কেন এই মাসটি এত গুরুত্বপূর্ণ? কেনই বা মুসলমানরা মহরম পালন করেন? এর পেছনে রয়েছে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক মহত্ত্ব।
মহরম শব্দটি এসেছে আরবি ‘মুহাররম’ থেকে, যার অর্থ পবিত্র বা সম্মানিত। ইসলামি শরিয়তে বছরের যে চারটি মাসকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়, মহরম তার মধ্যে অন্যতম। এই মাসের দশম দিন ‘আশুরা’ নামে পরিচিত, যে দিনটি কেবল ইসলামের ইতিহাসে নয়, বরং সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ইসলামে মহরমের ধর্মীয় মর্যাদা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা চারটি মাসকে বিশেষ সম্মানিত মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই মাসগুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মহরম ও রজব। এগুলোকে ‘আশহুরে হুরুম’ বা নিষিদ্ধ মাস বলা হয়, কারণ এই মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।
মহরম মাসের বিশেষত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানের রোজার পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হলো মহরম মাসের রোজা।” এই হাদিস থেকেই বোঝা যায় এই মাসের রোজার কত বেশি গুরুত্ব ইসলামে।
কারবালার মর্মন্তুদ ইতিহাস
মহরম পালনের মূল কারণ লুকিয়ে আছে কারবালার এক হৃদয়বিদারক ঘটনায়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৬১ সনের ১০ মহরম) ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ঘটে যায় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। এই দিনে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় নাতি, হজরত আলী (রা.)-এর পুত্র ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে শহীদ হন।
কারবালা শব্দটি এসেছে আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’ থেকে, যার অর্থ যথাক্রমে সংকট ও মুসিবত। এই নামকরণ যেন এই স্থানের ভবিষ্যত ইতিহাসের প্রতিফলন। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে দাঁড়িয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, মিথ্যা ও অত্যাচারের কাছে মাথা নত করার চেয়ে মৃত্যুবরণ করা অনেক শ্রেয়।
আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
মহরমের দশম দিন ‘আশুরা’ কেবল কারবালার ঘটনার জন্যই বিখ্যাত নয়। ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী, এই দিনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে এই দিনেই সৃষ্টি করা হয়। হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবনের পর জুদি পাহাড়ে এই দিনেই এসে ভিড়ে।
আশুরার দিনে হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায় ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেছিলেন এই দিনেই। এমনকি ফেরাউন ও তার সৈন্যরা নীল নদের পানিতে ডুবে মরেছিল এই আশুরার দিনে।
শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মহরম পালন
ইসলামের দুই প্রধান সম্প্রদায় শিয়া ও সুন্নি উভয়েই মহরম পালন করেন, তবে তাদের পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য এই মাসটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতকে কেন্দ্র করে এই মাস পালন করেন।
শিয়ারা মহরমের প্রথম দিন থেকে দশম দিন পর্যন্ত শোক পালন করেন। তারা কালো পোশাক পরেন, তাজিয়া নিয়ে শোভাযাত্রা বের করেন এবং বিশেষ মার্সিয়া গান পরিবেশন করেন। অন্যদিকে সুন্নি সম্প্রদায় মহরমের নবম ও দশম তারিখে রোজা রাখেন এবং বিশেষ নামাজ পড়েন।
রোজা ও অন্যান্য আমল
মহরম মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো আশুরার রোজা। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরতের পর দেখেন যে ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, এই দিনে আল্লাহ হজরত মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বললেন, “মুসা (আ.)-এর সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরাই বেশি হকদার।” তারপর তিনি নিজেও রোজা রাখেন এবং সাহাবিদের রোজা রাখার নির্দেশ দেন।
তবে ইয়াহুদিদের সাথে পার্থক্য করার জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজার সাথে আরও একটি রোজা যোগ করতে। অর্থাৎ ৯ ও ১০ মহরম অথবা ১০ ও ১১ মহরম – এভাবে দুটি রোজা রাখা সুন্নত।
আধুনিক বিশ্বে মহরমের প্রভাব
আজকের বিশ্বে মহরম পালন শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন মানুষ অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়, তখন কারবালার শিক্ষা তাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক সহ বিশ্বের অনেক দেশেই মহরম পালন করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কারবালার শিক্ষা ও আমাদের জীবন
কারবালার ঘটনা আমাদের শেখায় যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য দাঁড়ানোর চেয়ে বড় কোনো কাজ নেই। ইমাম হুসাইন (রা.) সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস করা যায় না।
আজকের যুগেও আমরা দেখি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। কারবালার শিক্ষা আমাদের সাহস যোগায় সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যুগে যুগে ন্যায়ের জয় হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
সাংস্কৃতিক প্রভাব ও সাহিত্য
মহরম ও কারবালার ঘটনা বিশ্ব সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বাংলা সাহিত্যে মীর মোশার্রফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য কবিতা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত।
পারস্য, আরবি, উর্দু, সিন্ধি, তুর্কি সহ বিভিন্ন ভাষায় মার্সিয়া ও নোহা রচিত হয়েছে। এগুলো শুধু সাহিত্যকর্ম নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে গভীর আবেগের সঞ্চার করে এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জোগায়।
মহরম পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সেই শিক্ষাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা। এই পবিত্র মাসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইসলামের মূল শিক্ষা হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মহরম তাই শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং মানবতার বিজয়ের চিরন্তন বার্তাবাহক। প্রতি বছর এই মাস এলে আমরা নতুন করে শপথ নিই – সত্যের পক্ষে থাকার, ন্যায়ের জন্য লড়াই করার এবং কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার।