Unsung revolutionaries of India: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উর্দু ভাষার ভূমিকা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য প্রায়ই আড়ালে থেকে যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে উর্দু কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল না, বরং এটি ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষা যা হিন্দু, মুসলিম ও শিখ—সব সম্প্রদায়ের মানুষকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিল। বিপ্লবী আন্দোলনের নেতারা, কবি-সাহিত্যিকরা এবং সাংবাদিকরা উর্দুকে ব্যবহার করেছিলেন তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহের বাণী পৌঁছে দিতে, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
গদর পার্টির মতো বিপ্লবী সংগঠনগুলো উর্দুকে তাদের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি ছিল পাঞ্জাবি অভিবাসী শ্রমিক, বাঙালি ও পাঞ্জাবি বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রদের একটি জোট যারা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ঐক্যের উপর জোর দিয়েছিল। তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘গদর’ উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হত এবং এটি বিশ্বব্যাপী ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল। এই পত্রিকার মাধ্যমে তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত এবং সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য ভারতীয়দের উৎসাহিত করত।
শহীদ ভগৎ সিং এবং তার সহযোগীদের ক্ষেত্রেও উর্দুর প্রভাব অপরিসীম ছিল। বিপ্লবী কবি হাসরত মোহানী কর্তৃক ১৯২১ সালে রচিত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি ভগৎ সিং জনপ্রিয় করে তোলেন। এই উর্দু স্লোগানটি হয়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের যুদ্ধক্রি। ১৯২৯ সালের এপ্রিলে দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা নিক্ষেপের পর ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত এই স্লোগান উচ্চারণ করেছিলেন। এমনকি ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও ভগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেব এই উর্দু স্লোগান চিৎকার করে উচ্চারণ করেছিলেন।
উর্দু সাহিত্যে অমুসলিম লেখক ও কবিদের অবদান ছিল অসাধারণ। আমেরিকান উর্দু ভাষাবিদ সি.এম. নাইমের মতে, উর্দু গদ্য সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ রচিত হয়েছিল অমুসলিমদের, বিশেষত হিন্দুদের দ্বারা। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, হিন্দু, রাজপুত এবং আর্য সমাজের সদস্যরা সবাই এই ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। ব্রিটিশরা ফার্সির পরিবর্তে উর্দুকে প্রতিস্থাপন করেছিল, এবং এটি একটি রসিকতার বিষয় ছিল যে হিন্দু, মুসলিম ও শিখরা পারস্পরিক কথোপকথনে পাঞ্জাবি ব্যবহার করত, কিন্তু অফিসে তারা সবাই উর্দুতে যোগাযোগ করত।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তার আজাদ হিন্দ ফৌজের মূলমন্ত্র হিসেবে উর্দু শব্দগুলো—’ইত্তেহাদ, ইতেমাদ, কুরবানি’ (ঐক্য, বিশ্বাস, ত্যাগ) গ্রহণ করেছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে উর্দু শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ভাষা ছিল না, বরং এটি ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের একটি শক্তিশালী প্রতীক। বাংলার নবজাগরণের লেখকদের থেকে শুরু করে আর্য সমাজ পর্যন্ত, উর্দুর প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় উর্দু সাংবাদিকতা একটি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল। দিল্লি উর্দু আখবারের মতো পত্রিকাগুলো জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তুলতে এবং দমনমূলক সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং মন্তব্য করেছিলেন যে ‘দেশীয় সংবাদপত্র’ ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে কৌশলগত ও শিল্পকুশলতার সাথে কাজ করছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে উর্দু কবিতার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বিসমিল আজিমাবাদীর ১৯২১ সালের গজল ছিল একক উদ্দেশ্য নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানুষদের জন্য একটি সাহসী সম্মাননা—ভারতের স্বাধীনতা। কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলায় রামপ্রসাদ বিসমিলের ফাঁসির আগে আবৃত্তি করা উর্দু কবিতার পংক্তি “সরফরোশি কি তামান্না আব হামারে দিল মেইন হ্যায়” আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এই কবিতার শব্দগুলো নিজস্ব জীবন পেয়েছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
উর্দু সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। অধ্যাপক মৃণাল চ্যাটার্জির মতে, উর্দু সাহিত্যের তিন থেকে চারটি স্বতন্ত্র পর্যায় রয়েছে এবং এই পর্যায়গুলো বুঝতে হলে অবিভক্ত ভারতের দিকে তাকাতে হবে। প্রথমে ছিল রোমান্টিক পর্যায়, ক্রমশ এল সামাজিক চেতনা, এবং এর সাথে এল কবিতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে বিদ্রোহের ধারণা। আকবর এলাহাবাদীর কথায়, “জব তোপ মুকাবিল হো তো আখবার নিকালো” (যখন কামানের মুখোমুখি হও, তখন সংবাদপত্র বের করো)—এই কথাটি উর্দু ভাষার বিপ্লবী শক্তির পরিচয় বহন করে।
হিন্দি-উর্দু বিতর্কের প্রেক্ষাপটে দেখলে বোঝা যায় যে উর্দুকে কেবল মুসলিম ভাষা বলে চিহ্নিত করা ইতিহাসের একটি বিকৃতি। স্যার সৈয়দ আহমদ খান নিজেই উর্দুকে “হিন্দু ও মুসলমানদের একটি সাধারণ উত্তরাধিকার” বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে উর্দু একটি সাংস্কৃতিক সেতু যা বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একসাথে আবদ্ধ করতে পারে। কিন্তু ১৮৬৭ সালের হিন্দি-উর্দু বিতর্ক যখন শুরু হয়, তখন রাজনৈতিক কারণে ভাষাটি সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
গদর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ছিলেন। সোহন সিং ভাকনা থেকে শুরু করে লালা হরদয়াল—সবাই উর্দুকে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করা, এবং এই লক্ষ্যে উর্দু ভাষা ছিল তাদের একতার প্রতীক। “গদর” শব্দটি নিজেই উর্দুতে “বিপ্লব” অর্থে ব্যবহৃত হত, যা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ থেকে অনুপ্রাণিত ছিল।
সেই সময়ের উর্দু সংবাদপত্রের মালিকানার দিকে তাকালে দেখা যায় যে হিন্দু ও মুসলিম—উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই মাধ্যমে কাজ করতেন। লালা লাজপত রায়ের উর্দু সংবাদপত্র ‘বন্দে মাতরম’ এবং মহাশয় কৃষ্ণের ‘প্রতাপ’ পত্রিকা এর উজ্জ্বল উদাহরণ। পাকিস্তানি পণ্ডিত ও কবি আব্দুল মজিদ সালিকের জীবনীতে উল্লেখ আছে যে ‘জমিন্দার’, ‘ইনকিলাব’ এবং ‘সিয়াসত’ পত্রিকাগুলো যদিও নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, কিন্তু হিন্দু উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে তারা একটি সাধারণ ফ্রন্ট গঠন করেছিল।
উর্দু কবিতা ও সাহিত্যে বিভিন্ন ধর্মের কবি ও লেখকদের অবদান স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। মুহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ, ওয়ালি শাহ, হাতিম, মীর, সওদা, মীর হাসান, ইনশা আল্লাহ খান, আনিস থেকে শুরু করে আজাদ ও হালি—সবাই ভারতের দৃশ্যপট, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, সামাজিক নিয়ম, ইতিহাস এবং রূপকের মাধ্যমে দেশপ্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছেন। ইকবালের কবিতা পশ্চিমা রাজনীতির ব্যঙ্গ করত এবং ভারতের সংস্কৃতির সার্বজনীনতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলকতাকে উৎসাহিত করত।
প্রেমচাঁদ ও ইকবালের নেতৃত্বে প্রগতিশীল আন্দোলন উর্দু সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তারা বাস্তবতার শিল্প শেখালেন এবং উর্দু ছোটগল্পকে রোমান্টিকতা থেকে বাস্তবতার দিকে নিয়ে গেলেন। এই পরিবর্তন স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, যেখানে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল জনগণের জীবনের প্রতিফলন এবং সংগ্রামের হাতিয়ার।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উর্দু ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। এটি কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না, বরং ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক অস্ত্র। বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই ভাষাকে ব্যবহার করে তাদের দেশপ্রেম ও বিদ্রোহী চেতনা প্রকাশ করেছেন। আজকের বিভাজিত সমাজে উর্দুর এই অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস স্মরণ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভাষা কখনো কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়—বরং এটি মানবিক অভিব্যক্তি ও সংগ্রামের সার্বজনীন মাধ্যম।
আজকের প্রেক্ষাপটে উর্দু ভাষাটি মূলত মুসলিম পরিবারগুলোতে টিকে আছে, যা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। বিভাজনের পর এই ভাষা তার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র হারিয়েছে এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে উর্দু ছিল একটি স্বতন্ত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষা যা হিন্দু, মুসলিম ও শিখদের একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিল। আমেরিকান পণ্ডিত সি.এম. নাইমের ভাষায়, “দুঃখজনক সত্য হলো উর্দু আর এমন একটি ভাষা নয় যা উভয় সম্প্রদায় সমানভাবে ভাগাভাগি করে, সমান আবেগ ও প্রতিভা দিয়ে। এটি এখন একটি মুসলিম উদ্যোগ, এবং এর ভাষাগত ও অ-ভাষাগত উভয় ধরনের পরিণতি রয়েছে।”