যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আজ ১৭ মার্চ ২০২৫ সোমবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ড এই উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বলেও জানানো হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে গেলে দেখা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। গত কয়েক মাসে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে বিশৃঙ্খলার খবর সামনে আসছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সম্পত্তি ধ্বংস এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তুলসি গ্যাবার্ড তার সাক্ষাৎকারে বলেন, এই ধরনের সহিংসতা শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি নষ্ট করছে না, বরং এটি বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগকেও বাড়িয়ে তুলছে। তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসন এই ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া, গ্যাবার্ড ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয় নয়, বরং দেশের সব স্তরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।
এই উদ্বেগের পেছনে আরও গভীর কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে গত বছরের শেষ দিক থেকে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এই সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, মন্দির ভাঙচুর এবং সহিংসতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনাগুলো শুধু দেশের ভেতরেই আলোড়ন সৃষ্টি করেনি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আগেও বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে কথা বলেছে। গত ৮ নভেম্বর ২০২৪-এ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছিল, তারা বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখতে চায়।
বিষয়টির গভীরতা বোঝার জন্য আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত। গ্যাবার্ড তার সাক্ষাৎকারে ‘ইসলামিস্ট সন্ত্রাসী হুমকি’র কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই ধরনের গোষ্ঠী একটি ‘ইসলামপন্থী খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে, যা অন্য ধর্মের মানুষদের জন্য হুমকি। তিনি আরও বলেন, এই গোষ্ঠীগুলো সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে, যা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, তারা এই ইস্যুতে নজর রাখছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
এদিকে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তখন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা সামাজিক সম্প্রীতির জন্যও বড় হুমকি। অনেকে মনে করছেন, এই সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। গত ৩ ডিসেম্বর ২০২৪-এ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দেখে মনে হচ্ছে, এখনও পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়াও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত ৮ মার্চ ২০২৫-এ এক্স প্ল্যাটফর্মে একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যদিও এটি পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি, তবে এটি পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝায়। এছাড়া, গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশ সরকারকে ‘পূর্ণ সমর্থন’ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর এই ইস্যুতে আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। সরকার যদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব পড়তে পারে। সাধারণ মানুষ আশা করছে, দ্রুত এই অস্থিরতার অবসান হবে এবং দেশে আবার শান্তি ফিরে আসবে।