বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক মাসব্যাপী চলা বাণিজ্য উত্তেজনার অবসান ঘটেছে একটি ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে। স্কটল্যান্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েনের মধ্যে গত রোববার (২৭ জুলাই) অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর ঘোষণা করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া সকল ইউরোপীয় পণ্যের ওপর ১৫% শুল্ক আরোপ করা হবে। এই হার পূর্বঘোষিত ৩০% শুল্কের তুলনায় অর্ধেক, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দীর্ঘ আলোচনার ফসল এই চুক্তিটি স্কটল্যান্ডের টার্নবেরি গল্ফ রিসোর্টে সম্পন্ন হয়েছে। ট্রাম্প এই চুক্তিকে “এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় চুক্তি” আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছি। এটি সবার জন্য একটি ভালো চুক্তি”। একইসাথে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন এটিকে “স্থিতিশীলতা আনার একটি বড় সুযোগ” হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, “এই চুক্তি আমাদের দুই পক্ষের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করবে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করে”।
জুলাই ৯ তারিখের আগে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি: জয়শঙ্কর বললেন ‘অত্যন্ত জটিল আলোচনা চলছে’
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি পণ্য ক্রয় করবে, যার মধ্যে রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল এবং পারমাণবিক জ্বালানি। এই বিনিয়োগ ইউরোপকে রাশিয়ার জ্বালানি নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু নির্দিষ্ট খাতে শূন্য শুল্ক প্রয়োগ করবে। বিমানের যন্ত্রাংশ, কিছু রাসায়নিক পণ্য ও কৃষিপণ্যসহ নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে কোনো শুল্ক বসানো হবে না। তবে বিশ্বব্যাপী স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে ট্রাম্পের আরোপিত ৫০% শুল্ক বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
এই চুক্তি এমন এক সময়ে সম্পাদিত হয়েছে যখন ট্রাম্প ১ আগস্টের মধ্যে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসার চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। এর পূর্বে তিনি ইউরোপীয় পণ্যে ৩০% শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। আরও আগে ২ এপ্রিলে তিনি ২০% শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু নতুন এই চুক্তিতে শুল্কের পরিমাণ ১৫% নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ইউরোপের জন্য অনেকটা স্বস্তিদায়ক।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই চুক্তিকে উভয় পক্ষের জন্য একটি ‘আংশিক বিজয়’ হিসেবে দেখছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এটি এক ধরনের ‘ক্ষতি নিয়েই মীমাংসা’ হলেও আরও খারাপ পরিস্থিতি এড়ানো গেছে। এই ১৫% শুল্ক যুক্তরাজ্যের ১০% চুক্তির তুলনায় বেশি, কিন্তু জাপানের সদ্য সমাপ্ত ১৫% চুক্তির সমপর্যায়েই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই চুক্তি বার্ষিক প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আয় নিশ্চিত করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় নেতারা এই চুক্তি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিশেল মার্টিন বলেছেন, “শুল্ক হার আগের তুলনায় বেশি হওয়ায় বাণিজ্য আরও ব্যয়বহুল ও জটিল হবে”। অন্যদিকে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “নিয়মিত ও স্থিতিশীল বাণিজ্য সম্পর্কই দুইপক্ষের ব্যবসা ও ভোক্তাদের জন্য সর্বোত্তম”। আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের মতো একাধিক দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনা চলছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আগেরবার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ইউরোপের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের মতো কিছু পণ্যে শুল্ক বসিয়েছিলেন। এর প্রত্যুত্তরে ইউরোপও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যে পাল্টা শুল্ক বসায়। এর ফলে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবসা নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল।
এবারের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিতে ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ও বিশ্ব অর্থনীতি পুনর্গঠনে প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের নীতি গ্রহণ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি তিনি যুক্তরাজ্য, জাপান, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামের সাথেও শুল্ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। যদিও তার ৯০ দিনে ৯০টি চুক্তি করার লক্ষ্য পূরণ হয়নি, তবুও এসব চুক্তি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
নতুন এই বাণিজ্য চুক্তি আগামী শুক্রবার থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এটি শুধু দুই অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে সম্পর্কের উন্নতির একটি বড় পদক্ষেপই নয়, বরং বৈশ্বিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ফেরানোর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উরসুলা ভন ডার লেয়েন ট্রাম্পকে “একজন কঠিন আলোচক, কিন্তু একইসাথে একজন দক্ষ চুক্তিকারক” হিসেবে প্রশংসা করেছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি এবং এই অগ্রগতি অর্জনে তার নেতৃত্বের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এই মন্তব্য দুই নেতার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উন্নতি এবং ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতার সম্ভাবনা ইঙ্গিত করে।
ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিন: বিশ্বব্যবস্থা উল্টে দিচ্ছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চুক্তি কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নতিই আনবে না, বরং ইউরোপের শক্তি নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমেরিকান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল এবং পারমাণবিক জ্বালানিতে ইউরোপের বিনিয়োগ রাশিয়ান জ্বালানির উপর তাদের নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করবে। এটি ইউক্রেইন যুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা হয়ে উঠেছে।
সামগ্রিকভাবে এই বাণিজ্য চুক্তি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক সংকেত প্রেরণ করেছে। বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে সহযোগিতার এই মনোভাব অন্যান্য দেশের জন্যও একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। তবে এই চুক্তির বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।