মধ্যপ্রাচ্য, বিশ্ব রাজনীতির এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল অঞ্চল। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি এক প্রভাবশালী নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কাতারসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের একাধিক দেশে স্থাপিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো কেবল আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থই রক্ষা করে না, বরং এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্যকেও প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে চলেছে। কয়েক দশক ধরে বিস্তৃত এই সামরিক উপস্থিতি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি, কৌশলগত অংশীদারিত্ব এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও, এর পেছনে রয়েছে জটিল ভূ-রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের এক দীর্ঘ ইতিহাস।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাতার। diminutive এই উপসাগরীয় দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ধারণ করে আছে। রাজধানী দোহার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিটি মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) সম্মুখ সদর দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশাল ঘাঁটি থেকে আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়াসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন বিমান পরিচালিত হয়েছে। প্রায় ১১,০০০ মার্কিন সেনা ও সহায়ক персонала এই ঘাঁটিতে অবস্থান করে, যা এটিকে এই অঞ্চলের যেকোনো মার্কিন স্থাপনার চেয়ে বৃহৎ করে তুলেছে। আল উদেইদের সুবিশাল রানওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বিমানগুলোকে ওঠানামা করার সুযোগ দেয়, যা দ্রুত সেনা মোতায়েন এবং রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুবিধা প্রদান করে। সাম্প্রতিক সময়ে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত নতুন চুক্তি অনুযায়ী, আল উদেইদের কার্যক্রম আরও দশ বছরের জন্য বর্ধিত করা হয়েছে, যা এই অঞ্চলের প্রতি মার্কিন দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন ঘটায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখন আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন? জানুন বিস্তারিত
কাতারের পাশাপাশি কুয়েতও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক কার্যক্রমের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে কুয়েতে মার্কিন সেনার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। ইরাকের সাথে সীমান্ত থাকার কারণে কুয়েতের ঘাঁটিগুলো কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্প আরিফজান এবং আলি আল সালেম বিমান ঘাঁটির মতো স্থাপনাগুলো মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য প্রধান লজিস্টিকস এবং ট্রানজিট হাব হিসেবে কাজ করে। এই ঘাঁটিগুলোতে প্রায় ১৩,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, যারা ইরাক ও সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনাকারী বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করে। কুয়েতের সাথে আমেরিকার একটি মজবুত প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যা এই সামরিক উপস্থিতিকে বৈধতা এবং ভিত্তি প্রদান করে।
দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন আকারে ছোট হলেও মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাহরাইনের মানামায় মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহরের (Fifth Fleet) সদর দফতর অবস্থিত। এই নৌবহর পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের কিছু অংশে মার্কিন সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষা এবং জলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত। হরমুজ প্রণালীর মতো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত তেল পরিবহন রুটের কাছে এর অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহের ওপর নজরদারি করার সুযোগ করে দেয়। প্রায় ৭,০০০ মার্কিন নৌসেনা বাহরাইনে অবস্থান করে, যা এই দেশটিকে মার্কিন নৌ-কৌশলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ঘনিষ্ঠ সামরিক অংশীদার। দেশটির আল ধাফরা বিমান ঘাঁটিতে মার্কিন বিমানবাহিনীর অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং গোয়েন্দা ড্রোন মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া জেবেল আলি বন্দরটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর জন্য বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নোঙর করার সুবিধা প্রদান করে। আমিরাতে প্রায় ৫,০০০ মার্কিন সেনা উপস্থিত রয়েছে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কার্যক্রমে উভয় দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পরিচায়ক। এই সামরিক উপস্থিতি ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক হিসেবেও কাজ করে।
Attack on Kashmir Army Camp: রক্তাক্ত উপত্যকা,কাশ্মীরে সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হামলা, বাড়ছে উত্তেজনা
সৌদি আরবের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও, সামরিক সহযোগিতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের পর প্রিন্স সুলতান বিমান ঘাঁটি থেকে অধিকাংশ মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেখানে আবারও মার্কিন সেনার উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে, যারা মূলত প্যাট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম পরিচালনা এবং সৌদি বাহিনীকে প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত। এই উপস্থিতি সৌদি আরবের আকাশসীমা এবং তেল ক্ষেত্রগুলোকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে।
ওমানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত প্রবেশাধিকার চুক্তি রয়েছে, যা দেশটিকে সরাসরি ঘাঁটি স্থাপন না করেও এর বন্দর এবং বিমানবন্দরগুলো সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। দুকম এবং সালালাহ-এর মতো বন্দরগুলো মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে রসদ সরবরাহ এবং মেরামতের জন্য ব্যবহৃত হয়। হরমুজ প্রণালীর বাইরে ওমানের এই কৌশলগত অবস্থান মার্কিন বাহিনীকে ইরানের সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে আরব সাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেয়, যা জরুরি পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জর্ডান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বিশ্বস্ত মিত্র, যেখানে প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। এই সেনারা মূলত সিরিয়া সীমান্তের কাছে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোতে অবস্থান করে এবং সিরিয়ার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় সহায়তা করে। জর্ডানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়, যা উভয় দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করে।
ইরাক এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। ইরাকে বর্তমানে প্রায় ২,৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছে, যারা সরাসরি যুদ্ধ অভিযানে অংশ না নিয়ে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনীকে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামিক স্টেটের পুনরুত্থান রোধ করা। অন্যদিকে, সিরিয়ায় প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনা কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর সাথে কাজ করছে, যাদের মূল উদ্দেশ্যও একই—আইএসকে প্রতিহত করা এবং এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব সীমিত রাখা। এই দুটি দেশে মার্কিন উপস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং প্রায়শই স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়।
সামগ্রিকভাবে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর এই বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ওয়াশিংটনের জন্য এক বিশাল কৌশলগত সম্পদ। এটি একদিকে যেমন আমেরিকার জাতীয় স্বার্থ, যেমন—জ্বালানি নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন এবং মিত্রদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, তেমনই অন্যদিকে এই অঞ্চলের রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তবে এই উপস্থিতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায়শই আঞ্চলিক সংঘাত এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে হয়। স্থানীয় জনগণের একাংশের মধ্যে মার্কিন-বিরোধী মনোভাব এবং ইরান ও তার মিত্রশক্তিগুলোর পক্ষ থেকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ এই ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তাকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে ফেলে। সুতরাং, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি একটি দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো, যা একদিকে যেমন স্থিতিশীলতা রক্ষার দাবি করে, তেমনই অন্যদিকে নতুন সংঘাতের বীজও বপন করে চলেছে।