রুশ তেলের ‘জরিমানা’য় ভারতের বিপাকে ৫০% শুল্ক: মোকাবিলার তিন কৌশল নিয়ে দ্বিধায় নয়াদিল্লি

Chanchal Sen 5 Min Read

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট শুল্কের হার এখন দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখার ‘শাস্তি’ হিসেবে এই অভূতপূর্ব শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের ওপর আরোপিত মার্কিন শুল্কের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের সামনে তিনটি পথ খোলা রয়েছে – কূটনৈতিক আলোচনা, পাল্টা শুল্ক আরোপ এবং অমার্কিন ব্লকের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক নতুন মোড় নিয়েছে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক। গত বুধবার হোয়াইট হাউসের নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে ট্রাম্প জানান, ভারত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাশিয়ার তেল কিনে চলেছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করছে। এই কারণে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

ট্রাম্পের কঠোর শুল্ক নীতি: ভারতীয় রপ্তানিতে আঘাত, টেক্সটাইল থেকে রত্ন-অলংকার পর্যন্ত সব খাতেই সংকট

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীন ও তুরস্কের মতো দেশগুলোও রাশিয়ার তেল কিনলেও তাদের ওপর এ ধরনের শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়নি। এক্ষেত্রে ট্রাম্প ভারতকে এককভাবে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

নতুন শুল্ক ব্যবস্থায় ৭ আগস্ট থেকে প্রথম ২৫ শতাংশ এবং ২৭ আগস্ট থেকে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে। এর ফলে ভারতের চামড়া, রাসায়নিক, জুতা, রত্ন ও গয়না, বস্ত্র এবং চিংড়ি রপ্তানি খাত সবচেয়ে বড় ধাক্কার মুখে পড়বে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআই এর মতে, এই শুল্কের ফলে মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে এবং রপ্তানি ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। জৈব রাসায়নিক খাতে অতিরিক্ত ৫৪ শতাংশ, কার্পেটে ৫২.৯ শতাংশ, নিট পোশাকে ৬৩.৯ শতাংশ এবং হীরা, সোনা ও গয়নায় ৫২.১ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় প্রথম বিকল্প হলো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। অনেকেই মনে করছেন যে, আমেরিকা ও ভারতের কর্মকর্তারা বাণিজ্য নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসতে পারেন। চলতি মাসের শেষের দিকে আমেরিকার বাণিজ্যদল ভারতে আসছে, যা একটি সুযোগ হতে পারে।

তবে পূর্বের অভিজ্ঞতা আশাব্যঞ্জক নয়। প্রাথমিকভাবে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পাঁচ দফা বাণিজ্য আলোচনার পর ভারতীয় কর্মকর্তারা আশাবাদী ছিলেন যে চুক্তি অনুযায়ী শুল্ক সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু ভারত কৃষি-বাজারে প্রবেশাধিকার এবং দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছিল, যা ট্রাম্পকে হতাশ ও বিরক্ত করেছে।

দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে ভারত পাল্টা শুল্ক আরোপের পথ বেছে নিতে পারে। কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা শশী থারুর ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে আমদানি করা মার্কিন পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা উচিত। বর্তমানে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে গড়ে ১৭ শতাংশ শুল্ক নেয়।

তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হলো আমেরিকা-বিরোধী দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি। ভারতের মতো ব্রাজিলের ওপরেও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে আমেরিকা। ভারত ও ব্রাজিল উভয়েই ব্রিকস জোটের সদস্য। ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা জানিয়েছেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ফোনে কথা বলবেন এবং চীন ও রাশিয়ার সাথে আলোচনা করবেন।

ইতোমধ্যে রাশিয়ার সাথে কথাবার্তা চালু হয়েছে এবং চলতি মাসের শেষে পুতিন ভারত সফরে আসছেন। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ট্রাম্পের হুমকির মধ্যে অন্যান্য দেশের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে পারে, যেসব দেশ ভারতের মতোই আমেরিকার কোপে পড়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান: ইউরোপীয় পণ্যে ১৫% শুল্কে ঐতিহাসিক সমঝোতা

অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে দেখলে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে ১৩১.৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারতের রপ্তানি ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ৪৫.৩ বিলিয়ন ডলার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এক অর্থবর্ষে আমেরিকায় ৭.৬ লাখ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে ভারত, যা ভারতের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।

ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের শীর্ষ সংগঠন সিআইটিআই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৫০ শতাংশ শুল্ক হার গভীর উদ্বেগের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বস্ত্র ও পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। তারা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, এ কঠিন সময়ে খাতটিকে দ্রুত সহায়তা দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

কামা জুয়েলারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কলিন শাহ বলেছেন, এ পদক্ষেপ ভারতের রপ্তানিতে বড় ধরনের আঘাত কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের মোট রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ এই শুল্কের আওতায় পড়বে। ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যত রপ্তানিকারকদের ৩০-৩৫ শতাংশ প্রতিযোগিতামূলক বাধার মুখে ফেলেছে।

এদিকে রপ্তানিকারকদের আশা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি দ্রুত চূড়ান্ত হলে শুল্কসংক্রান্ত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে। দুই দেশ এখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে এবং ২০২৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রাথমিক চুক্তি সইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের মোকাবিলায় ভারতের সামনে যে তিনটি পথ খোলা রয়েছে, প্রতিটিরই নিজস্ব ঝুঁকি ও সুবিধা রয়েছে। কূটনৈতিক সমাধান সবচেয়ে আদর্শ হলেও পূর্বের ব্যর্থতার ইতিহাস রয়েছে। পাল্টা শুল্ক বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র করতে পারে। আর তৃতীয় পথ ভারতকে পশ্চিমা জোট থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের নীতিনির্ধারকদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো কোন পথ বেছে নিয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সর্বোচ্চ সুরক্ষিত রাখা যায়।

Share This Article