US Hikes Tariffs to 50% on Indian Exports: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখার অভিযোগে ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্কের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের টেক্সটাইল, রত্ন-অলংকার, চামড়া, চিংড়ি এবং রাসায়নিক পদার্থের মতো প্রধান রপ্তানি খাতগুলো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই নতুন শুল্ক কাঠামো ভারতের মার্কিন রপ্তানি ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে।
গত বুধবার ট্রাম্প প্রশাসনের এই ঘোষণা ভারত-মার্কিন বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন মাত্রার উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। মার্কিন হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে যে ভারতের রাশিয়ান তেল আমদানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া বিরোধী প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তবে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, চীন এবং তুরস্কের মতো অন্যান্য দেশ যারাও রাশিয়া থেকে তেল কিনে থাকে, তাদের ওপর এ ধরনের কোনো অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়নি।
শুল্কের এই নতুন কাঠামো দুই পর্যায়ে কার্যকর হবে। প্রথম ২৫ শতাংশ শুল্ক ৭ আগস্ট থেকে এবং অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে মোট শুল্কের হার ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো বাণিজ্যিক অংশীদারের জন্য সর্বোচ্চ শুল্কের হারগুলোর মধ্যে একটি। এই শুল্ক বৃদ্ধি ভারতকে ব্রাজিলের সাথে একই পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে উভয় দেশই এখন ৫০ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন।
ট্রাম্পের ২৫% শুল্ক ঘোষণায় কাঁপছে ভারত: রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে ক্ষুব্ধ আমেরিকা
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো প্রভাবিত খাতগুলোর বিশাল আর্থিক মূল্য। টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে ভারতের রপ্তানি মূল্য ১০.৩ বিলিয়ন ডলার, রত্ন ও অলংকার খাতে ১২ বিলিয়ন ডলার, চিংড়ি রপ্তানিতে ২.২৪ বিলিয়ন ডলার, চামড়া ও জুতার খাতে ১.১৮ বিলিয়ন ডলার, রাসায়নিক পদার্থে ২.৩৪ বিলিয়ন ডলার এবং বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক যন্ত্রপাতিতে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। এই সব মিলিয়ে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি এই নতুন শুল্কের আওতায় পড়বে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিটিআরআই (GTRI) এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জৈব রাসায়নিক পদার্থের রপ্তানিতে এখন অতিরিক্ত ৫৪ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য হবে। অন্যান্য খাতে শুল্কের হার হবে: কার্পেট ৫২.৯ শতাংশ, বোনা পোশাক ৬৩.৯ শতাংশ, তাঁত পোশাক ৬০.৩ শতাংশ, টেক্সটাইল পণ্য ৫৯ শতাংশ, হীরা ও স্বর্ণজাত পণ্য ৫২.১ শতাংশ, যন্ত্রপাতি ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম ৫১.৩ শতাংশ এবং আসবাবপত্র ৫২.৩ শতাংশ।
টেক্সটাইল খাতের জন্য এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি (CITI) জানিয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। সংস্থাটি এই ৫০ শতাংশ শুল্কের হারের “গভীর নেতিবাচক প্রভাব” নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে যে এই শুল্ক বৃদ্ধি ভারতীয় টেক্সটাইল রপ্তানিকারকদের ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং মার্কিন বাজারে অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতায় তাদের দুর্বল অবস্থানে ফেলে দেবে।
রত্ন ও অলংকার শিল্পও মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে। কামা জুয়েলারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কলিন শাহ জানিয়েছেন যে এই পদক্ষেপ ভারতীয় রপ্তানির জন্য একটি মারাত্মক ধাক্কা, কারণ ভারতের মার্কিন রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ সরাসরি প্রভাবিত হবে। ৫০ শতাংশ শুল্ক কম শুল্কহারের দেশগুলোর তুলনায় ভারতীয় রপ্তানিকারকদের ৩০-৩৫ শতাংশ প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় ফেলে দেবে। অনেক রপ্তানি অর্ডার ইতিমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে কারণ ক্রেতারা উচ্চ খরচের কারণে তাদের সোর্সিং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করছেন।
চিংড়ি রপ্তানি খাতেও বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কলকাতা ভিত্তিক সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানিকারক মেগা মোডার ব্যবস্থাপনা পরিচালক যোগেশ গুপ্ত জানিয়েছেন যে এর ফলে মার্কিন বাজারে ভারতীয় চিংড়ি অনেক বেশি দামী হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে ইকুয়েডরের সাথে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন ভারতীয় চিংড়ি রপ্তানিকারকরা, কারণ ইকুয়েডরের জন্য মাত্র ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য। ভারতীয় চিংড়িতে ইতিমধ্যে ২.৪৯ শতাংশ অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক এবং ৫.৭৭ শতাংশ কাউন্টারভেইলিং শুল্ক রয়েছে। নতুন ২৫ শতাংশ শুল্ক যোগ হওয়ার ফলে ৭ আগস্ট থেকে মোট শুল্ক ৩৩.২৬ শতাংশ হয়ে যাবে।
চামড়া শিল্পেও গভীর উদ্বেগ রয়েছে। এই খাতের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের (MSME) পক্ষে এই আকস্মিক খরচ বৃদ্ধি সামলানো কঠিন হবে। ইতিমধ্যে পাতলা মার্জিনের মধ্যে কাজ করা এই খাতের রপ্তানিকারকদের দীর্ঘদিনের ক্লায়েন্ট হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। অনেক রপ্তানিকারক জানিয়েছেন যে তাদের কারখানা চালু রাখতে এবং গণ ছাঁটাই এড়াতে খরচের নিচে বিক্রি করতে হতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৩১.৮ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ভারতের রপ্তানি ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ৪৫.৩ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে রয়েছে, যা এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনস (FIEO) এর মহাপরিচালক অজয় সাহাই জানিয়েছেন যে এই পদক্ষেপ “অত্যন্ত ধাক্কাদায়ক” এবং এটি ভারতের মার্কিন রপ্তানির ৫৫ শতাংশকে প্রভাবিত করবে। তবে কিছু স্বস্তির বিষয় হলো যে ট্রানজিটে থাকা পণ্য এবং ৭ আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত যাত্রার জন্য জাহাজে লোড করা পণ্যগুলো এই শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাবে।
ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিন: বিশ্বব্যবস্থা উল্টে দিচ্ছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে ৫০ শতাংশ শুল্কের হার ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একআইসিআইসিআই সিকিউরিটিজের প্রধান অর্থনীতিবিদ এ. প্রসন্না বলেছেন যে ৫০ শতাংশ হারে অনেক ভারতীয় রপ্তানি ১৫-৩০ শতাংশ হারের দেশগুলোর তুলনায় অসুবিধায় পড়বে। এইচডিএফসি ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ শক্তি গুপ্ত আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই শুল্ক অব্যাহত থাকলে ২০২৬ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হতে পারে।
রত্ন ও অলংকার এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কিরিট ভানসালি এই ৫০ শতাংশ শুল্ককে ভারতীয় রত্ন ও অলংকার খাতের জন্য “কিয়ামতের দিন” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে এই খাতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করার বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। অনেক কোম্পানি ইতিমধ্যে দুবাই এবং মেক্সিকোর মতো দেশে উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের কথা ভাবছে যাতে কম শুল্কে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকার এবং শিল্প সংস্থাগুলো মার্কিন প্রশাসনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে। আগামী ১৯ আগস্ট মার্কিন রত্ন ও অলংকার শিল্পের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে এই শুল্ক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, যার প্রথম পর্যায় এই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। রপ্তানিকারকরা আশা করছেন যে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির দ্রুত চূড়ান্তকরণ শুল্কের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তা করবে।