Uttam Kumar Death Anniversary: আজ ২৪ জুলাই, ২০২৪। বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮০ সালের এই দিনে বাঙালি সিনেমার এক যুগের অবসান ঘটেছিল। কিন্তু আজও উত্তম কুমারের স্মৃতি বাঙালির হৃদয়ে অম্লান। চলুন আজ ফিরে দেখি মহানায়কের জীবন, কর্ম এবং তাঁর অবদানের কথা।
উত্তম কুমারের জীবনের প্রথম দিকে
উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর পরিবারের থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ ছিল, যা তাঁর অভিনয় জীবনের প্রেরণা হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ
উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে ‘দ্রোহকাল’ ছবির মাধ্যমে। প্রথম দিকে তাঁর কয়েকটি ছবি ব্যর্থ হওয়ায় তিনি কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরিবারের উৎসাহে তিনি আবার অভিনয়ে ফিরে আসেন।
সফলতার শিখরে
১৯৫০ এর দশক থেকে উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর অভিনীত বেশ কিছু ছবি বক্স অফিসে সাফল্য পায়। এই সময় থেকেই তিনি ‘মহানায়ক’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেন।উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের জুটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি হিসেবে পরিচিত। তাঁরা একসঙ্গে ৩৯টি ছবিতে অভিনয় করেছেন, যা একটি রেকর্ড।
ছবির নাম | প্রকাশের বছর |
---|---|
অগ্নিপরীক্ষা | ১৯৫৪ |
শাপমোচন | ১৯৫৫ |
সাগরিকা | ১৯৫৬ |
পথের পাঁচালী | ১৯৫৭ |
হারানো সুর | ১৯৫৭ |
ইন্দ্রাণী | ১৯৫৮ |
চাওয়া পাওয়া | ১৯৫৯ |
উত্তম কুমারের শ্রেষ্ঠ অভিনয়
উত্তম কুমার তাঁর কর্মজীবনে প্রায় ৩৭৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি:
- নায়ক (১৯৬৬)
- চিড়িয়াখানা (১৯৬৭)
- অন্তরীক্ষ (১৯৭৫)
- বনহংসী (১৯৭৯)
পুরস্কার ও সম্মাননা
উত্তম কুমার তাঁর অভিনয় জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ৮ বার বাংলা ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (BFJA) পুরস্কার জিতেছেন, যা একটি রেকর্ড।
শেষের দিকে
১৯৭৬ সাল থেকে উত্তম কুমারের ক্যারিয়ারে ভাটা পড়তে শুরু করে। তবে এর মধ্যেও তিনি কিছু সফল ছবি করেছেন। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘দুই পৃথিবী’ ছিল তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তিপ্রাপ্ত শেষ ছবি।
মৃত্যু ও উত্তরকাল
১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উত্তম কুমারের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক যুগের অবসান ঘটে।তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ (১৯৮১) ছবিটি বক্স অফিসে বড় সাফল্য পায় এবং ২৬ সপ্তাহ চলে।
উত্তম কুমারের উত্তরাধিকার
উত্তম কুমারের প্রভাব আজও বাংলা চলচ্চিত্রে অনুভূত হয়। ২০০৯ সালে কলকাতার টলিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ‘মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন’ রাখা হয়। একই বছর ভারতীয় ডাক বিভাগ তাঁর স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।২০১২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘মহানায়ক সম্মান’ পুরস্কার প্রদান করছে, যা উত্তম কুমারের নামে প্রতিষ্ঠিত।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে উত্তম কুমার
উত্তম কুমারের জীবন নিয়ে ২০১৬ সালে ‘মহানায়ক’ নামে একটি টেলিভিশন সিরিজ নির্মিত হয়, যেখানে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০২২ সালে ‘অচেনা উত্তম’ নামে একটি বায়োপিক মুক্তি পায়, যেখানে শশ্বত চট্টোপাধ্যায় উত্তম কুমারের ভূমিকায় অভিনয় করেন।২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অতি উত্তম’ ছবিতে VFX ব্যবহার করে উত্তম কুমারকে পর্দায় ফিরিয়ে আনা হয়। এই ছবিতে উত্তম কুমারের ৫৪টি ছবির ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে।
উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের জুটি বাঙালির হৃদয়ে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এই দুই মহানায়কের অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা এবং পর্দায় তাদের অনবদ্য রসায়ন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। চলুন দেখে নেওয়া যাক কেন এই জুটি এতটা জনপ্রিয় ছিল:
অনবদ্য পর্দা কেমিস্ট্রি
উত্তম-সুচিত্রা জুটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল তাদের মধ্যকার অসাধারণ রোমান্টিক কেমিস্ট্রি। পর্দায় তাদের উপস্থিতি এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে দর্শকরা তাদের বাস্তব জীবনেও একসাথে দেখতে চাইতেন। তাদের অভিনয়ে যে ইন্টেনসিটি ছিল তা দর্শকদের মুগ্ধ করত।
বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় দক্ষতা
উত্তম-সুচিত্রা শুধু রোমান্টিক চরিত্রেই নয়, কমেডি থেকে শুরু করে ট্র্যাজেডি – সব ধরনের চরিত্রে সমান দক্ষতার সাথে অভিনয় করতে পারতেন। এটা তাদের জুটিকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছিল।
সময়ের প্রতিফলন
১৯৫০ এর দশক থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত উত্তম-সুচিত্রার জুটি বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা এবং জীবনযাপনের ছবি তুলে ধরেছিল। এটা দর্শকদের সাথে একটা আত্মিক যোগাযোগ তৈরি করেছিল।
গানের ব্যবহার
তাদের ছবিগুলোতে গীতা দত্তের কণ্ঠে গাওয়া গানগুলো রোমান্সের আবহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই গানগুলো ছবির রোমান্টিক মুহূর্তগুলোকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলত।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা
উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তাদের অভিনয়ে প্রতিফলিত হত, যা দর্শকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত।
ব্যক্তিগত জীবনের প্রভাব
তাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনা, যেমন সুচিত্রা সেনের স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ বা উত্তম কুমারের জটিল পারিবারিক সম্পর্ক, তাদের অভিনীত চরিত্রগুলোকে আরও গভীরতা দিয়েছিল।
চলচ্চিত্রের বৈচিত্র্য
উত্তম-সুচিত্রা একসাথে প্রায় ৩০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
ছবির নাম | প্রকাশের বছর | বিশেষত্ব |
---|---|---|
শারে চুয়াট্টর | ১৯৫৩ | প্রথম একসাথে অভিনীত ছবি |
অগ্নিপরীক্ষা | ১৯৫৪ | রোমান্টিক ড্রামা |
হারানো সুর | ১৯৫৭ | অ্যামনেসিয়া নিয়ে গল্প |
সবার উপরে | ১৯৫৫ | সামাজিক বিষয়ভিত্তিক |
পথে হলো দেরি | ১৯৫৭ | রোমান্টিক ড্রামা |
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
উত্তম-সুচিত্রা জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার জুটি হিসেবে পরিচিত। তাদের জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তাদের ছবিগুলো আজও OTT প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয়।
সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
আজও নতুন প্রজন্মের কাছে উত্তম-সুচিত্রার ছবিগুলো সমান জনপ্রিয়। এটা প্রমাণ করে যে তাদের অভিনয় এবং জুটির আবেদন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।সারকথা, উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের জুটি শুধু দুজন তারকা অভিনেতার সমন্বয় ছিল না, এটি ছিল একটি যুগের প্রতিনিধি। তাদের অভিনয়, ব্যক্তিত্ব এবং পর্দায় উপস্থিতি বাঙালি দর্শকদের হৃদয় জয় করেছিল এবং আজও সেই আবেদন অম্লান রয়েছে। এই জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি স্বর্ণযুগের প্রতীক হয়ে থাকবে।
ব্যক্তি উত্তম কুমার কেমন ছিলেন? তাকে নিয়ে কয়েকটি মজার ঘটনা
উত্তম কুমার শুধু একজন মহান অভিনেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনের নানা দিক এবং কয়েকটি মজার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা যাক:
ব্যক্তিত্ব
উত্তম কুমার ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ। তিনি শুধু অভিনেতাই ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, সংগীত পরিচালক এবং পার্শ্বগায়কও। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক ছিল:
- দানশীল: তিনি দরিদ্র শিল্পী ও কারিগরদের সাহায্য করতেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ‘শিল্পী সংসদ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা দরিদ্র শিল্পী ও কারিগরদের সাহায্য করত।
- সংগীতপ্রেমী: উত্তম কুমার সংগীত ভালোবাসতেন, হারমোনিয়াম বাজাতেন এবং গান রচনা করতেন।
- ক্রীড়াবিদ: তিনি ভবানীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনে টানা তিন বছর সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
- স্বাধীনতা সংগ্রামী: ১৯৪৫ সালে তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি রিলিফ ফান্ডে সাহায্য করেছিলেন।
- পরোপকারী: ১৯৭৮ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলা ও বম্বে চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে একটি চ্যারিটি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন।
মজার ঘটনা
- পোস্টার বিতর্ক: ১৯৫৪ সালের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির পোস্টারে লেখা ছিল “অগ্নিপরীক্ষা আমাদের চিরন্তন প্রেমের সাক্ষী”। এই ক্যাপশন নিয়ে উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরী দেবী এবং সুচিত্রা সেনের স্বামী দীননাথ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
- সরোজ খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ: বিখ্যাত বলিউড কোরিওগ্রাফার সরোজ খান একবার কলকাতায় এসেছিলেন উত্তম কুমারের ‘১৯৬১ সালের ‘সাথী হারা’ ছবির একটি গানের জন্য কাজ করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন উত্তম কুমার জ্বরে অসুস্থ ছিলেন।
- সুচিত্রা-সুপ্রিয়া কথোপকথন: ১৯৭২ সালে ‘হার মানা হার’ ছবির শুটিংয়ের সময় সুচিত্রা সেন নাকি সুপ্রিয়া দেবীকে হালকা ছলে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের নাচ দেখে তিনি ঈর্ষান্বিত কিনা। সুপ্রিয়া দেবী উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি এই রোমান্টিক দৃশ্যগুলো বড় পর্দায় অনেকবার দেখেছেন, তাই এটা তাঁর কাছে স্বাভাবিক।
- অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী: উত্তম কুমার ১৯৬০-৬১ সালে ‘হারানো দিনগুলি মোর’ নামে তাঁর আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পরে ১৯৭৯-৮০ সালে তিনি আবার ‘আমার আমি’ নামে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন, কিন্তু হঠাৎ মৃত্যুর কারণে তাও অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
- রেডিও বিতর্ক: ১৯৭৬ সালে উত্তম কুমারকে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চণ্ডীপাঠ পাঠ করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। কিন্তু দর্শকরা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পরিবর্তে তাঁকে নেওয়ার জন্য সমালোচনা করেন। পরে উত্তম কুমার ক্ষমা চেয়ে নেন এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে পুনর্বহাল করা হয়।
উত্তম কুমার ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, সংবেদনশীল এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাসম্পন্ন মানুষ। তাঁর জীবন শুধু চলচ্চিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান রেখেছিলেন।