উত্তরকাশীতে হড়পা বানের তাণ্ডব: মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি, শতাধিক নিখোঁজ, বৃষ্টির মধ্যেই অব্যাহত উদ্ধারকাজ

মঙ্গলবার দুপুরে উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার ধরালী গ্রামে আচমকা নেমে আসা হড়পা বানে মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত অন্তত চার থেকে পাঁচজনের মৃত্যুর নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও শতাধিক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়ে গেছেন। ১২৬০০ ফুট উচ্চতা থেকে ক্ষীরগঙ্গা নদী ধরে নেমে আসা এই ভয়াবহ জলস্রোত মুহূর্তেই গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা তছনছ করে দিয়েছে। অবিরাম বৃষ্টির মাঝেই এনডিআরএফ, এসডিআরএফ ও সেনাবাহিনীর যৌথ তৎপরতায় উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি শুরু হয় মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ যখন প্রবল মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে পাহাড়ের উপর থেকে বিশাল জলরাশি ধেয়ে আসে। ক্ষীরগঙ্গা নদীর উচ্চ অববাহিকা থেকে কাদা, পাথর আর জলের মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই জলস্রোত ঘণ্টায় ৪৩ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে গ্রামের উপর। মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ত্রিভুজাকার ধরালী গ্রামের অর্ধেকটাই কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

গঙ্গোত্রী যাওয়ার পথে অবস্থিত ধরালী একটি জনপ্রিয় পাহাড়ি পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে একাধিক হোটেল ও হোমস্টে রয়েছে। জলের তোড়ে ভেসে গেছে ৪০ থেকে ৫০টি বাড়ি, হোটেল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ক্ষীরগঙ্গা নদীর অববাহিকায় বন্যার জল একাধিক হোটেলে ঢুকে পড়েছে এবং বাজার এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গিয়েছে। ধরালীর কাছে ভাটওয়াড়িতে প্রায় দেড়শো মিটার রাস্তা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

উদ্ধারকাজে নেমেছে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ), রাজ্য দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী (এসডিআরএফ), সেনাবাহিনী এবং আইটিবিপি যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। মঙ্গলবার রাত্রি থেকেই হেলিকপ্টার ও ড্রোনের মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় নজরদারি চলছে। যেসব এলাকায় রাস্তা ভেঙে গেছে, সেখানে পায়ে হেঁটে বা দড়ি বেয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। নিখোঁজ মানুষদের খোঁজার জন্য এনডিআরএফের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরও নামানো হয়েছে।

এনডিআরএফ এবং স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় এখনও পর্যন্ত ১৩০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে উদ্ধারকাজে বাধা সৃষ্টি করছে অবিরাম বৃষ্টিপাত। বুধবারও উত্তরাখণ্ডের আবহাওয়ার তেমন পরিবর্তন হয়নি এবং টানা বৃষ্টি চলছে। ভারতীয় আবহাওয়া দফতর আগামী ২৪ ঘণ্টা উত্তরকাশী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরও ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন অন্তত ১০-১১ জন সেনা জওয়ান। হরশিলে অবস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পও এই হড়পা বানের কবলে পড়েছে। সুখি টপ এলাকাতেও একইরকম মেঘভাঙা বৃষ্টির ক্ষতি হয়েছে। এই এলাকা থেকেও ৯ জন নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় নির্দেশনা আসছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামির সঙ্গে ফোনে কথা বলে ধরালী অঞ্চলের সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ত্রাণ-উদ্ধার অভিযানের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব রকম সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও ফোনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ধরালীতে ক্ষয়ক্ষতির খোঁজখবর নিয়েছেন।

বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার আদর্শ গন্তব্য: পকেট ফ্রেন্ডলি ট্যুরিজমের সম্পূর্ণ গাইড

মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি জানিয়েছেন যে রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজ চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে।

দুর্গতদের অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং খাবার, জল ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় উদ্ধারকাজে বাধা তৈরি হচ্ছে। আইটিবিপি রাস্তা মেরামতে ব্যস্ত রয়েছে। স্কুল, দোকান, হোটেল সবকিছুই বন্ধ রয়েছে এই এলাকায়।

উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চল বরাবরই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। এখানে মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান এবং ভূমিধসের মতো ঘটনা প্রায়শই ঘটে। ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চামোলি জেলার ঋষিগঙ্গা উপত্যকায় একটি হিমবাহ ভেঙে পড়ে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছিল। সেই ঘটনায়ও শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ এই ধরনের দুর্যোগের পিছনে বড় কারণ। পাহাড়ি অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান পর্যটন এবং উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে।

উত্তরকাশী জেলা হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এবং এখানকার ভৌগোলিক গঠনই এমন যে মেঘভাঙা বৃষ্টির সময় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বিশাল জলরাশি দ্রুত নিচের দিকে নেমে আসে। গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীর মতো তীর্থস্থানের কাছাকাছি হওয়ায় এই এলাকায় প্রচুর পর্যটক আসেন, যা এই ধরনের দুর্যোগের সময় ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে।

চলমান উদ্ধারকাজে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আবহাওয়া। অবিরাম বৃষ্টির কারণে হেলিকপ্টার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে এবং ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে। তবুও উদ্ধারকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও উদ্ধারকাজে সহায়তা করছেন।

ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে যাতে আবহাওয়ার উন্নতি হলেই আকাশপথে উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়। এছাড়াও আরও এনডিআরএফ দল পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

Weather Forecast 27 August 2024: বৃষ্টির মাঝে গরম! আগামীকাল কেমন

রুদ্রপ্রয়াগে রাতভর অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে অলকানন্দা নদী বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এবং সাময়িকভাবে কেদারনাথ যাত্রা স্থগিত করা হয়েছে। বাগেশ্বরেও অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে এবং গোমতী ও সরযূ নদী উভয়ই উত্তাল। চণ্ডীগড়-মানালি জাতীয় সড়কও ভূমিধসের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।

এই ভয়াবহ হড়পা বানের ঘটনা আবারও উত্তরাখণ্ডের ভঙ্গুর পরিবেশগত অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই দুর্যোগ প্রস্তুতি, প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে আরও বেশি নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উত্তরকাশীর এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে।

Share This Article