জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় মাতা বৈষ্ণোদেবী মন্দিরের পথে মঙ্গলবার বিকেলে ভূমিধসের ঘটনায় কমপক্ষে ৫ জন তীর্থযাত্রী নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়েছেন। অধ্বকারীর ইন্দ্রপ্রস্থ ভোজনালয়ের কাছে এই ভূমিধস হয়েছে, যা ত্রিকূট পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত পবিত্র মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে অবস্থিত। অব্যাহত ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে বলে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে।
ত্রিকূট পাহাড়ের অধ্বকারী এলাকায় দুপুর ৩টার দিকে এই ভূমিধসের ঘটনা ঘটে, যে স্থানটি কাত্রা শহর থেকে পবিত্র গুহার দিকে ১২ কিলোমিটার পথের প্রায় অর্ধেক পথে অবস্থিত। শ্রী মাতা বৈষ্ণোদেবী শ্রাইন বোর্ড তাৎক্ষণিক একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, “অধ্বকারীর ইন্দ্রপ্রস্থ ভোজনালয়ের কাছে একটি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, কিছু আহতের আশঙ্কা রয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি সহ উদ্ধার কাজ চলমান রয়েছে”।
ভারতীয় সেনাবাহিনী এই দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কর্মীদের “উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য দ্রুত মোতায়েন” করেছে এবং জানিয়েছে যে “জীবন বাঁচানো, প্রয়োজনে সহায়তা প্রদান এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে”। আর্মির হোয়াইট নাইট কর্পসের তিনটি ত্রাণ কলামকে এই উদ্ধার অভিযানে দ্রুত মোতায়েন করা হয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এই পরিস্থিতিকে জম্মু প্রদেশের বিভিন্ন অংশে ‘যথেষ্ট গুরুতর’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ ও প্রতিক্রিয়া কার্যক্রম তদারকি করার জন্য শ্রীনগর থেকে জম্মুতে পরবর্তী উপলব্ধ ফ্লাইটে যাবেন। আঞ্চলিক প্রশাসন এই ঘটনার পর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পবিত্র বৈষ্ণোদেবী মন্দিরে তীর্থযাত্রা স্থগিত করে দিয়েছে।
গত তিনদিন ধরে ক্রমাগত ভারী বৃষ্টিপাত জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। হিমকোটি ট্রেক রুটে যাত্রা ইতিমধ্যে দিনের শুরুতেই স্থগিত করা হয়েছিল। তীর্থযাত্রীরা দুপুর ১:৩০ টা পর্যন্ত পুরাতন পথ ব্যবহার করে চলাচল করছিলেন, কিন্তু প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে কর্তৃপক্ষ এটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্যাটারি কার পরিষেবাও নিরাপত্তার খাতিরে স্থগিত করা হয়েছে।
কাত্রার কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে (সিএইচসি) মৃতদেহ এবং আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাত্রার উপবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) পীযূষ ধোত্রা এএনআইকে জানান, “উদ্ধার অভিযান চলমান রয়েছে। পাঁচটি মৃতদেহ সিএইচসি কাত্রায় আনা হয়েছে। দশ থেকে এগারোজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আরও তথ্য পাওয়া গেলে আমরা তা জানাবো”।
এই অঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। কাঠুয়ায় সর্বোচ্চ ১৫৫.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, এর পরে রয়েছে ভদরওয়াহে (দোদা) ৯৯.৮ মিলিমিটার, জম্মুতে ৮১.৫ মিলিমিটার এবং কাত্রায় ৬৮.৮ মিলিমিটার। সপ্তাহান্তে জম্মুতে একদিনেই ১৯০.৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা প্রায় ১০০ বছরের মধ্যে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত।
ভূমিধসের এই ঘটনার পাশাপাশি জম্মু বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পাওয়া গেছে। দোদা জেলায় মেঘ ফাটার ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে এবং ১০টিরও বেশি ঘরের ক্ষতি হয়েছে। এই অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে এলাকার অধিকাংশ নদনদী ও জলাশয় বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে এবং অনেক নিম্নাঞ্চল ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে।
পরিস্থিতির অবনতির সাথে সাথে জম্মু বিভাগের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বহু ভূমিধস এবং পাথর পড়ার ঘটনার কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে যানবাহন চলাচল স্থগিত করা হয়েছে। দোদা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক স্থানীয় নদীর তীর ভেঙে যাওয়ার পর ধুয়ে গেছে, যা এলাকাটিকে আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
তাবি নদী বানে ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে, আর কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়েছেন যে রাতভর নদনদী ও জলাশয়ের পানির উচ্চতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে জম্মু অঞ্চলের জন্য বন্যা সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং বাসিন্দাদের জলাশয় এবং ভূমিধসপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। প্রশাসন জনগণকে রিয়েল টাইমে ঘটনা বা বাধার খবর জানানোর জন্য অনুরোধ করেছে।
মাতা বৈষ্ণোদেবী মন্দির ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় তীর্থস্থান, যেখানে প্রতি বছর লাখো তীর্থযাত্রী দেশ-বিদেশ থেকে আসেন। কাত্রা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পর্বতের উপরে অবস্থিত এই পবিত্র গুহা মন্দিরে পৌঁছাতে হয়। ঐতিহ্যগতভাবে তীর্থযাত্রীরা কাত্রা থেকে মন্দির পর্যন্ত পায়ে হেঁটে, টট্টু বা পালকিতে করে যাত্রা সম্পন্ন করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যারা পুরো পথ পায়ে হাঁটতে অসমর্থ তাদের জন্য ব্যাটারি চালিত গাড়ি এবং হেলিকপ্টার সেবাও উপলব্ধ করা হয়েছে।
এই অঞ্চলে ভূমিধসের ঘটনা নতুন নয়। জম্মু ও কাশ্মীরের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে এখানে নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে থাকে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শুধুমাত্র এই অঞ্চলে ৫৪টি ভূমিধসের ঘটনায় প্রায় ৩৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ১৫ জন আহত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা আরও ঘন ঘন হচ্ছে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বৈষ্ণোদেবী যাত্রায় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য শ্রাইন বোর্ড এবং প্রশাসন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সিআরপিএফ ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ২৪×৭ সিসিটিভি নজরদারি ও রিয়েল-টাইম মনিটরিং এবং ইন্টিগ্রেটেড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার (আইসিসিসি) সম্পূর্ণভাবে চালু রয়েছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা সবসময় সম্ভব হয় না।
শ্রাইন বোর্ড নিয়মিত আবহাওয়া আপডেট, বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান করে যাতে তীর্থযাত্রীরা তাদের যাত্রার সময় ও গতি সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিশেষত বর্ষাকালে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকলেও পিচ্ছিল পথ এবং ভূমিধসের ঝুঁকির কারণে যাত্রার আগে আবহাওয়া সংক্রান্ত পরামর্শ দেখে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের এই দুর্ঘটনার পর উদ্ধার কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে হতাহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং আটকে পড়া তীর্থযাত্রীদের নিরাপদে উদ্ধার করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তীর্থযাত্রা পুনরায় শুরু করার আগে আবহাওয়ার উন্নতি এবং পথ নিরাপদ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।