ভারতীয় রেলওয়ে সম্প্রতি শ্রীমতা বৈষ্ণো দেবী কটরা থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচী প্রকাশ করেছে। এই আধুনিক ট্রেনটি জম্মু ও কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন আনতে চলেছে। শ্রীনগরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের সংযোগ আরও সহজ ও দ্রুত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই ট্রেনের ভাড়া ১,৫০০ থেকে ২,৫০০ টাকার মধ্যে থাকবে এবং উদ্বোধন হতে পারে চলতি বছরের মার্চের শেষে বা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। এই খবর পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার করেছে।
এই ট্রেনটি কটরা থেকে শ্রীনগরের মধ্যে চলাচল করবে এবং প্রতিদিনের সময়সূচীও নির্ধারণ করা হয়েছে। সকাল ৮:১০ মিনিটে কটরা থেকে ছাড়বে ট্রেনটি এবং ১১:২০ মিনিটে শ্রীনগরে পৌঁছাবে। ফিরতি যাত্রায় শ্রীনগর থেকে সকাল ৮:৫৫ মিনিটে রওনা দিয়ে দুপুর ১২:০৫ মিনিটে কটরায় ফিরবে। এছাড়া, দুটি মেল ট্রেনের সময়সূচীও প্রকাশ করা হয়েছে, তবে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধনের তারিখ এখনও চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। এই ট্রেনটি উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল সংযোগ (ইউএসবিআরএল) প্রকল্পের অধীনে চলবে, যা জম্মু ও কাশ্মীরের রেল যোগাযোগে নতুন মাত্রা যোগ করবে। ভাড়ার ক্ষেত্রে এসি চেয়ার কারের জন্য ১,৫০০ থেকে ১,৬০০ টাকা এবং এক্সিকিউটিভ চেয়ার কারের জন্য ২,২০০ থেকে ২,৫০০ টাকা নির্ধারণের সম্ভাবনা রয়েছে।
ঘটনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। ভারতীয় রেলওয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের কঠিন ভূখণ্ডে রেল পরিষেবা চালু করতে বছরের পর বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের এই নতুন রুটটি কটরা থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করবে মাত্র ৩ ঘণ্টায়। এই ট্রেনটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে কাশ্মীরের কঠোর শীতের পরিস্থিতিতেও এটি সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রেনের কামরায় হিটিং সিস্টেম এবং জলের লাইনে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে ঠান্ডায় জমে না যায়। এছাড়া, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেল সেতু চেনাব ব্রিজের ওপর দিয়ে এই ট্রেন চলবে, যা যাত্রীদের জন্য একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা হবে।
বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের এই রুটে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে থামবে। এর মধ্যে রয়েছে দিল্লি, আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট, লুধিয়ানা জংশন, পাঠানকোট ক্যান্টনমেন্ট, জম্মু তাওয়াই, শ্রীমতা বৈষ্ণো দেবী (কটরা), রিয়াসি, বানিহাল, কানজিগুণ্ড, অনন্তনাগ এবং শ্রীনগর। এই স্টপেজগুলো যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক হবে এবং পর্যটনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ট্রেনটি সপ্তাহে ছয় দিন চলবে এবং উত্তর রেলওয়ে জোন এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। ট্রেনটির উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে পতাকা নাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা এই প্রকল্পের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এই উদ্যোগের পেছনে আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। জম্মু ও কাশ্মীরে এটি তৃতীয় বন্দে ভারত এক্সপ্রেস হতে চলেছে। এর আগে দুটি রুটে এই ট্রেন চালু হয়েছে—নতুন দিল্লি থেকে কটরা এবং কটরা থেকে নতুন দিল্লি। এই নতুন রুটটি কাশ্মীর উপত্যকার প্রথম আধা-উচ্চগতির ট্রেন হবে। ইউএসবিআরএল প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালে প্রথম অনুমোদিত হয়েছিল এবং ২০০২ সালে জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই প্রকল্পের মোট খরচ এখন ৩৫,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটি শুধু যোগাযোগই নয়, পর্যটন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলবে।
কাশ্মীরের শীতের কঠিন পরিস্থিতির জন্য ট্রেনটিতে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বায়ো-টয়লেটে জল জমে যাওয়া রোধ করার ব্যবস্থা, কাভাচ নামে অ্যান্টি-কলিশন সিস্টেম, স্বয়ংক্রিয় দরজা, আরামদায়ক আসন এবং ওয়াই-ফাইয়ের মতো আধুনিক সুবিধা রয়েছে। এই ট্রেনটি মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও চলতে পারে। চালকের জন্য উত্তপ্ত উইন্ডশিল্ড রাখা হয়েছে, যাতে তুষারপাতের সময়ও দৃষ্টি পরিষ্কার থাকে। এসব বৈশিষ্ট্য এই ট্রেনকে অনন্য করে তুলেছে।
এই ট্রেন চালু হলে পর্যটকদের জন্য কাশ্মীর ভ্রমণ আরও সহজ হবে। বর্তমানে শ্রীনগরে যেতে অনেকে জম্মু পর্যন্ত ট্রেনে এসে তারপর সড়কপথে যান, যা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর। বন্দে ভারত এক্সপ্রেস এই সমস্যার সমাধান করবে। এছাড়া, স্থানীয়দের জন্যও যাতায়াত সহজ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ বাড়বে। ভারতীয় রেলওয়ের এই উদ্যোগকে অনেকে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেল’ বলে অভিহিত করেছেন, কারণ এটি কঠিন পাহাড়ি এলাকায় রেলপথ তৈরির একটি বিরাট সাফল্য।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, বন্দে ভারত এক্সপ্রেস শ্রীনগরের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের দূরত্ব কমিয়ে আনবে। এটি শুধু একটি ট্রেন নয়, বরং উন্নয়ন ও সংযোগের প্রতীক। আগামী দিনে এই রুটে আরও যাত্রী বাড়বে এবং কাশ্মীরের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে। তবে, চূড়ান্ত উদ্বোধনের তারিখ ও ভাড়ার বিষয়ে সরকারি ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এই ট্রেনটি কবে থেকে চলতে শুরু করবে, তা নিয়ে সবার আগ্রহ এখন তুঙ্গে।