আজ সোমবার দুপুর ২:২৮ মিনিটে সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন বামপন্থী চিন্তক, প্রাবন্ধিক ও নকশাল আন্দোলনের অন্যতম মুখ কমরেড আজিজুল হক। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করছিলেন এই প্রবীণ বিপ্লবী। বাড়িতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়ার পর থেকে তার শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে।
ভেন্টিলেশন সাপোর্টে দিন কাটানো এই বিপ্লবী নেতার শরীরে রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল মারাত্মকভাবে। একের পর এক জটিলতা কাটিয়ে ওঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না। আজিজুল হকের প্রয়াণে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের ইতিহাসে আজিজুল হকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভারতের সেই সময়ের বামপন্থী রাজনৈতিক মানচিত্রে তিনি ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবী নেতা চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর সিপিআই (এম-এল)-এর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
বাংলার মাটিতে নকশাল আন্দোলনের জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে আজিজুল হক রেখে গেছেন অমূল্য সব দলিল। তার রচিত “কারাগারে ১৮ বছর” গ্রন্থটি নকশাল আন্দোলন ও সত্তরের দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন জেলখানার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং রাজবন্দীদের ওপর চালানো নির্যাতনের মর্মান্তিক বিবরণ।
কারাগারে অতিবাহিত দীর্ঘ বছরগুলো আজিজুল হকের জীবনের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে, যার মধ্যে বিতর্কিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও ছিল, তাকে বারবার কারারুদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালে একবার মুক্তি পেলেও ১৯৮২ সালে আবার গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৮৬ সালে জেলের মধ্যে তার ওপর চালানো শারীরিক নির্যাতন এবং রাজ্যের কারাগারগুলোর করুণ অবস্থা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
জেলখানার অভ্যন্তরে আজিজুল হকের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের দুই মন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন চক্রবর্তী জেলে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা মন্তব্য করেছিলেন যে আজিজুল হকের প্যারোলে মুক্তি পাওয়া উচিত। এমনকি কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখার্জিও তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছিলেন বলে জানা যায়।
রাজনৈতিক দর্শনে আজিজুল হক ছিলেন অটুট। সমাজতন্ত্রের প্রতি তার বিশ্বাস কখনও টলেনি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “মানুষের জন্য মানবিক সমাজ গড়তে সমাজতন্ত্রের বিকল্প নেই। সে কারণেই লড়াই না থামিয়ে তাকে আরও সুসংহত করতে হবে।” তার মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিদিন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে প্রকৃত এক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা।
বিপ্লবী আদর্শে অবিচল থাকা এই মানুষটি বিশ্বাস করতেন যে সমাজ অবশ্যই বদলাবে। তিনি বলেছিলেন, “আমি বিপ্লবে বিশ্বাস করি। সেই বিপ্লবের স্বপ্নেই আমার দিনযাপন। দিন বদলের বিশ্বাস হারালে, দিনযাপনই অর্থহীন হয়ে পড়ে।” চেয়ারম্যান মাওয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি “গাছ যতই বিশ্রাম নিতে চাক, ঝড় বইবেই” তিনি প্রায়শই স্মরণ করতেন।
সাহিত্যচর্চাতেও আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। “কারাগারে ১৮ বছর” ছাড়াও তিনি লিখেছেন “মনু মহম্মদ হিটলার” নামক একটি বিতর্কিত গ্রন্থ। তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে একজন প্রকৃত বিপ্লবীর জীবনযাপনের সত্যিকারের চিত্র। সহবন্দী কমরেডদের হত্যা প্রত্যক্ষ করতে করতেই তিনি লিখে গেছেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত অধ্যায়।
প্রাবন্ধিক এবং বক্তা হিসেবেও আজিজুল হক ছিলেন সুপরিচিত। তার লেখা ও বক্তব্যে সর্বদা প্রতিফলিত হয়েছে গভীর রাজনৈতিক চেতনা এবং সমাজ পরিবর্তনের দৃঢ় প্রত্যয়। বামপন্থী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আজিজুল হক শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও মানসিকভাবে তিনি ছিলেন অটুট। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। বাড়িতে পড়ে গিয়ে হাত ভাঙার ঘটনার পর থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি শুরু হয়। চিকিৎসকেরা তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার রক্তে মারাত্মক সংক্রমণ ধরা পড়ে। একের পর এক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে। চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু আজ দুপুরে সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে চিরতরে চোখ বন্ধ করলেন এই মহান বিপ্লবী।
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনীতিতে আজিজুল হকের মৃত্যু এক বিরাট শূন্যস্থান সৃষ্টি করবে। তার মতো দৃঢ়চেতা, আদর্শবাদী এবং আপসহীন নেতা বর্তমান যুগে বিরল। নকশাল আন্দোলনের ইতিহাসে তার অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, লেখক এবং সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ।
কমরেড আজিজুল হকের প্রয়াণে বাংলার বিপ্লবী রাজনীতি হারাল একজন কিংবদন্তিকে। তার রেখে যাওয়া আদর্শ এবং লেখনী ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বাম রাজনীতির এই অবিচল পথিকের বিদায় নিঃসন্দেহে এক যুগের অন্ত ঘটাল।