ভগবান বিষ্ণু: পালনকর্তা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রক্ষক
হিন্দু ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), বিষ্ণু (পালনকর্তা) এবং শিব (ধ্বংসকর্তা)। এই তিনজনের মধ্যে ভগবান বিষ্ণু হলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভারসাম্য, ধর্ম (সঠিক পথ) এবং স্থিতি বজায় রাখার দায়িত্বে থাকা সর্বোচ্চ সত্তা। তিনি প্রেম, করুণা এবং সুরক্ষার প্রতীক।
যখনই পৃথিবীতে অধর্ম, অত্যাচার এবং বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়, তখনই ভগবান বিষ্ণু ধর্ম পুনঃস্থাপন করতে এবং সাধুদের রক্ষা করতে বিভিন্ন অবতারে (Avatara) অবতীর্ণ হন। তাঁর দশটি প্রধান অবতার, যা ‘দশাবতার’ নামে পরিচিত (যেমন মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ এবং কল্কি), এই মহাজাগতিক দায়িত্বের প্রমাণ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-তে, তাঁর কৃষ্ণ অবতাররূপে, তিনি অর্জুনকে ধর্মের পথে চলার উপদেশ দেন। গীতায় তিনি ঘোষণা করেছেন (৪.৭):
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।”
এর অর্থ: “যখনই ধর্মের পতন হয় এবং অধর্মের বৃদ্ধি হয়, হে ভারত, তখনই আমি নিজেকে প্রকাশ করি।” এই কারণেই বিষ্ণুর উপাসনা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি হিন্দুর জন্য শান্তি, স্থিতি এবং মোক্ষ (মুক্তি) লাভের পথ।
‘অভিষেক’ বা দেবতার স্নান: কেন এই প্রথা?
দেবতার মূর্তিকে স্নান করানোর ধারণাটি প্রথম নজরে অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে গভীর ধর্মীয় ও দার্শনিক তাৎপর্য রয়েছে। মন্দিরে বা গৃহে যে বিগ্রহ (মূর্তি) বা শালগ্রাম শিলা রাখা হয়, তা নিছক পাথর বা ধাতুর তৈরি বস্তু নয়। ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ নামক একটি বৈদিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেই মূর্তিতে নির্দিষ্ট দেবতার দিব্যশক্তিকে আবাহন করা হয়। তখন মূর্তিটি স্বয়ং ভগবানের ‘অर्चा-विग्रह’ (আরাধনার যোগ্য রূপ) হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই অর্চা-বিগ্রহকে জীবন্ত সত্তা হিসেবেই সেবা করা হয়। যেমন আমরা একজন অত্যন্ত সম্মানীয় অতিথিকে বা আমাদের প্রিয়জনকে স্বাগত জানাই, ঠিক তেমনই ভগবানের বিগ্রহকে প্রতিদিন জাগানো হয়, স্নান করানো হয়, নতুন বস্ত্র পরানো হয়, চন্দন-তুলসী অর্পণ করা হয় এবং ভোগ (খাদ্য) নিবেদন করা হয়।
‘অভিষেক’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘অভি’ (দিকে) এবং ‘সিচ্’ (সেচন করা) থেকে, যার অর্থ হল “পবিত্র জল বা অন্যান্য তরল দিয়ে সেচন করা”। এটি পূজার ষোড়শোপচার (১৬টি ধাপ) সেবার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
অভিষেকের মূল উদ্দেশ্য:
১. শুদ্ধিকরণ: এটি কেবল মূর্তির বাহ্যিক শুদ্ধি নয়, বরং ভক্তের মন এবং পরিবেশের শুদ্ধিকরণকেও বোঝায়।
২. শক্তি সঞ্চার: বিশ্বাস করা হয় যে মন্ত্র পাঠের সাথে পবিত্র তরল (যেমন গঙ্গার জল বা পঞ্চামৃত) ঢালার মাধ্যমে মূর্তির দিব্য শক্তি পুনরায় জাগ্রত এবং বর্ধিত হয়।
৩. প্রেমময় সেবা (ভক্তি): এটি ভগবানের প্রতি ভক্তের নিঃস্বার্থ প্রেম এবং আত্মসমর্পণের প্রকাশ। এই সেবার মাধ্যমে ভক্ত ভগবানের সাথে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করেন।
৪. তাপ উপশম: মূর্তিকে শীতল তরল দিয়ে স্নান করানোকে ভগবানের ‘তাপ’ বা ‘ক্লান্তি’ দূর করার একটি প্রতীকী সেবা হিসেবেও দেখা হয়।
এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি মূলত আগম শাস্ত্র (Agama Shastras) এবং পঞ্চরাত্র (Pancharatra) নামক প্রাচীন শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলিতে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, যা মন্দির এবং গার্হস্থ্য পূজার নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা করে।
গণেশ মন্ত্রের অলৌকিক শক্তি: জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এক মন্ত্রে!
বিষ্ণু স্নানের প্রধান মন্ত্রসমূহ: সরল থেকে বৈদিক
বিষ্ণুর অভিষেকের জন্য বিভিন্ন স্তরের মন্ত্র রয়েছে। একজন সাধারণ ভক্ত তার ভক্তি অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
সর্বাধিক পরিচিত ও সহজ মন্ত্র: দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র
এটিই সেই মূল মন্ত্র যা দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি, যেকোনো সময় ভগবান বিষ্ণুকে (বা তাঁর শালগ্রাম শিলাকে) স্নান করাতে পারেন।
মন্ত্র:
“ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়”
(Om Namo Bhagavate Vasudevaya)
অর্থ:
- ওঁ (Om): এটি পরম ব্রহ্ম বা চূড়ান্ত বাস্তবতার মহাজাগতিক শব্দ।
- নমো (Namo): আমি প্রণাম করি বা আত্মসমর্পণ করি।
- ভগবতে (Bhagavate): ভগবান বা দিব্য সত্তাকে, যিনি সমস্ত গুণের আধার।
- বাসুদেবায় (Vasudevaya): বসুদেবের পুত্র (শ্রীকৃষ্ণ) অথবা যিনি সর্বত্র বাস করেন (বাসু = বাস করা, দেব = ঈশ্বর)।
এই মন্ত্রটি শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ-এর মতো প্রধান বৈষ্ণব শাস্ত্রে মহিমান্বিত হয়েছে। এটি ‘মুক্তি মন্ত্র’ নামেও পরিচিত। এই এক মন্ত্র উচ্চারণ করেই জল, দুধ বা পঞ্চামৃত দিয়ে অভিষেক সম্পন্ন করা যায়।
পঞ্চামৃত স্নান মন্ত্র: পাঁচটি অমৃতের শক্তি
অভিষেকের সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ হল ‘পঞ্চামৃত স্নান’, অর্থাৎ পাঁচটি পবিত্র উপাদান দিয়ে স্নান। প্রতিটি উপাদান অর্পণের সময় নির্দিষ্ট বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয়, যা এর শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই মন্ত্রগুলি তৈত্তিরীয় সংহিতা (কৃষ্ণ যজুর্বেদের অংশ) থেকে নেওয়া হয়েছে।
১. দুগ্ধ (দুধ) স্নান: দুধ হল শুদ্ধতা, পুষ্টি এবং মঙ্গলময়তার প্রতীক।
মন্ত্র: “ওঁ পয়ঃ পৃথিব্যাং পয় ওষধীষু পয়ো দিব্যন্তরিক্ষে পয়োধাঃ। পয়স্বতীঃ প্রদিশঃ সন্তু মহ্যম্।।”
অর্থ: পৃথিবীতে যেমন পুষ্টিকর দুধ (জল) রয়েছে, ওষধিতে (উদ্ভিদ) যেমন রস রয়েছে, যেমন আকাশে (মেঘে) জল রয়েছে… তেমনি আমার জীবনও যেন পুষ্টি এবং মঙ্গলে ভরে উঠুক।
২. দধি (দই) স্নান: দই হল সমৃদ্ধি, ঘনত্ব এবং জীবনের বিকাশের প্রতীক।
মন্ত্র: “ওঁ দধিক্রাব্ণো অকারিষং জিষ্ণোরশ্বস্য বাজিনঃ। সুরভি নো মুখা করৎ প্র ণ আয়ূংষি তারিষৎ।।”
অর্থ: আমি সেই দধিক্রাবণের (অগ্নি বা সূর্যের প্রতীক) স্তব করি, যিনি বিজয়ী, দ্রুতগামী। তিনি আমাদের মুখ সুগন্ধযুক্ত করুন এবং আমাদের আয়ু বৃদ্ধি করুন।
৩. ঘৃত (ঘি) স্নান: ঘি হল যজ্ঞের প্রধান উপাদান, যা জ্ঞান, শক্তি, বিজয় এবং স্নিগ্ধতার প্রতীক।
মন্ত্র: “ওঁ ঘৃতং মিমিক্ষে ঘৃতমস্য যোনির্ঘৃতে শ্রিতো ঘৃতম্বস্য ধাম। অনুস্বধমাবহ মাদয়স্ব স্বাহা কৃতং বৃষভ বক্ষি হব্যম্।।”
অর্থ: আমি ঘৃত সেচন করছি। ঘৃতই এর উৎস, ঘৃতই এর ধাম (আশ্রয়)। হে প্রভু, এই ঘৃতাহুতি গ্রহণ করে প্রসন্ন হোন এবং যজ্ঞের হবি বহন করুন।
৪. মধু (Honey) স্নান: মধু হল মাধুর্য, আনন্দ এবং প্রকৃতির বিশুদ্ধতম উপাদানের প্রতীক।
মন্ত্র: “ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ। মধু নক্তমুষসো মধু মৎ পার্থিবং রজঃ। মধু দ্যৌরস্তু নঃ পিতা।।”
অর্থ: বাতাস যেন মধুরভাবে প্রবাহিত হয়, নদীগুলি যেন মধু ক্ষরণ করে। ওষধিগুলি আমাদের জন্য মধুময় হোক। রাত্রি এবং ঊষা মধুময় হোক। পৃথিবীর ধূলিকণা মধুময় হোক। দ্যুলোক (স্বর্গ) পিতা আমাদের প্রতি মধুময় হোন।
৫. শর্করা (চিনি/গুড়) স্নান: শর্করা হল জীবনের মিষ্টতা এবং পরম আনন্দের প্রতীক।
মন্ত্র: (এর জন্য নির্দিষ্ট বৈদিক মন্ত্র কম ব্যবহৃত হয়, সাধারণত ইক্ষু রস বা শর্করার জন্য পৌরাণিক মন্ত্র বা মূল মন্ত্র “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” ব্যবহার করা হয়।)
বৈদিক মন্ত্র: পুরুষ সূক্ত (Purusha Suktam)
বৃহৎ মন্দিরে (যেমন তিরুপতি, শ্রীরঙ্গম) বা বিশেষ অনুষ্ঠানে যখন ভগবান বিষ্ণুর (নারায়ণ) অভিষেক হয়, তখন সাধারণত ঋগ্বেদ থেকে নেওয়া ‘পুরুষ সূক্ত’ পাঠ করা হয়। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী সূক্ত যা ভগবানকে সেই আদি ‘পুরুষ’ বা মহাজাগতিক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করে, যাঁর থেকে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে।
সূক্তের শুরু:
“সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বা অত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।।”
অর্থ: “সেই পরম পুরুষের সহস্র (অসংখ্য) মাথা, সহস্র চোখ এবং সহস্র পা। তিনি সমগ্র ভূমিকে (বিশ্বকে) পরিব্যাপ্ত করে দশ আঙ্গুল (তার বাইরেও) অতীতে অবস্থান করছেন।”
এই সূক্ত পাঠের মাধ্যমে অভিষেক করা হল ভগবানকে তাঁর বিশ্বরূপে পূজা করা। এটি পূজার সর্বোচ্চ রূপগুলির মধ্যে একটি।
পুরাণোক্ত ও সহজ মন্ত্র (গৃহ পূজার জন্য)
যারা উপরের বৈদিক মন্ত্রগুলিতে অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য পুরাণগুলি সহজ মন্ত্র প্রদান করে। জল অর্পণের সময় এটি বলা যেতে পারে:
“ওঁ সর্বতীর্থসমুদ্ভূতং পাছাং গন্ধাদভিঃ।
ময়া নিবেদিতং ভক্ত্যা গৃহাণ পুরুষোত্তম।।”
অর্থ: “সমস্ত তীর্থ থেকে উদ্ভূত এই সুগন্ধি জল, হে পুরুষোত্তম, আমি ভক্তিভরে নিবেদন করছি, দয়া করে গ্রহণ করুন।”
বিষ্ণু স্নানের সম্পূর্ণ পদ্ধতি (গৃহ পূজার জন্য)
বাড়িতে ভগবান বিষ্ণুর বিগ্রহ বা শালগ্রাম শিলার অভিষেক করার একটি সরল অথচ শাস্ত্রীয় পদ্ধতি নিচে দেওয়া হলো।
পূজার প্রস্তুতি ও উপকরণ
- আত্মশুদ্ধি: স্নান শুরু করার আগে ভক্তকে নিজে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করতে হবে।
- স্থান: পূজার স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি শান্ত পরিবেশ তৈরি করুন।
- উপকরণ:
- বিষ্ণুর বিগ্রহ বা শালগ্রাম শিলা।
- একটি প্রশস্ত পাত্র (স্নানপাত্র বা তাম্রপাত্র) যেখানে বিগ্রহকে রেখে স্নান করানো হবে।
- একটি ছোট কলস বা পাত্র (শঙ্খ হলে উত্তম) জল ঢালার জন্য।
- শুদ্ধ জল (সম্ভব হলে গঙ্গা জল মিশ্রিত)।
- পঞ্চামৃত (দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি – আলাদা বাটিতে)।
- সুগন্ধি জল (চন্দন, কর্পূর, গোলাপ জল মিশ্রিত)।
- একটি নরম, পরিষ্কার কাপড় (বিগ্রহ মোছার জন্য)।
- তুলসী পাতা (আবশ্যক)।
- ফুল, চন্দন, ধূপ, প্রদীপ এবং নৈবেদ্য (ফল বা মিষ্টান্ন)।
সংকল্প (Sankalpa)
যেকোনো পূজার আগে ‘সংকল্প’ বা মানসিক প্রতিজ্ঞা করা হয়। হাতে সামান্য জল, ফুল ও আতপ চাল নিয়ে বলুন:
“আমি (আপনার নাম), (আপনার গোত্র), আজ (দিনের তিথি, মাস, বর্ষ উল্লেখ করে), ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সন্তুষ্টি এবং আমার পরিবারের মঙ্গল কামনায় (বা নির্দিষ্ট কোনো কামনা উল্লেখ করে) এই অভিষেক পূজা সম্পন্ন করছি।”
স্নানের পর্যায়ক্রম (The Sequence of Bathing)
১. সাধারণ জল স্নান (Jala Snana): প্রথমে বিগ্রহকে স্নানপাত্রে রাখুন। শঙ্খ বা কলস দিয়ে শুদ্ধ জল ঢালুন এবং ক্রমাগত “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” মন্ত্র জপ করুন।
২. পঞ্চামৃত স্নান (Panchamrita Snana): এবার একে একে পঞ্চামৃতের প্রতিটি উপাদান দিয়ে স্নান করান। প্রতিটি উপাদান অর্পণের সময় নির্দিষ্ট মন্ত্র (যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে) বা কেবল “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বলুন।
* প্রথমে দুধ, তারপর দই, তারপর ঘি, তারপর মধু এবং শেষে শর্করা।
৩. শুদ্ধোদক স্নান (Shuddhodaka Snana): পঞ্চামৃতের আঠালো ভাব দূর করার জন্য আবার শুদ্ধ জল দিয়ে ভালোভাবে স্নান করান। এই সময় পুরুষ সূক্ত বা বিষ্ণু সহস্রনামের কিছু অংশ পাঠ করা যেতে পারে।
৪. গন্ধোদক স্নান (Gandhodaka Snana): শেষে, চন্দন, কর্পূর বা ফুল মিশ্রিত সুগন্ধি জল দিয়ে স্নান করান।
স্নান পরবর্তী সেবা (Service after the Bath)
স্নান শেষ হলেই পূজা শেষ নয়, বরং আসল সেবা শুরু হয়।
১. অঙ্গ বস্ত্র: একটি পরিষ্কার, নরম কাপড় দিয়ে বিগ্রহকে আলতো করে মুছুন।
২. বস্ত্র ও উপবীত: ভগবানকে নতুন বস্ত্র (হলুদ বা পীত বর্ণের হলে উত্তম) এবং পৈতা (যজ্ঞোপবীত) অর্পণ করুন।
৩. চন্দন ও তুলসী: বিগ্রহের কপালে বা চরণে চন্দন তিলক দিন। বিষ্ণু পূজায় তুলসী পাতা অপরিহার্য। প্রতিটি উপচারের সাথে “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বলে তুলসী পাতা অর্পণ করুন।
৪. পুষ্প: সুগন্ধি ফুল অর্পণ করুন।
৫. ধূপ ও দীপ: ধূপ জ্বালিয়ে আরতি করুন এবং ঘিয়ের প্রদীপ দেখান।
৬. নৈবেদ্য: ফল, মিষ্টান্ন বা সাধ্যমতো ভোগ নিবেদন করুন।
৭. আরতি ও প্রার্থনা: শেষে কর্পূর দিয়ে আরতি করুন এবং নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করুন।
অভিষেকের পর যে জল (পঞ্চামৃত ও জল মিশ্রিত) স্নানপাত্রে জমা হয়, তাকে ‘চরণামৃত’ (Charanamrita) বলে। এটি অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং ভক্তরা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন।
শালগ্রাম শিলা স্নান: বিশেষ তাৎপর্য
বিষ্ণু পূজায় ‘শালগ্রাম শিলা’ (Shaligrama Shila) এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে প্রাপ্ত এই পবিত্র কালো জীবাশ্ম শিলাকে ভগবান বিষ্ণুর স্বয়ম্ভূ (নিজে থেকে প্রকাশিত) বা অনাকৃতি (aniconic) রূপ বলে মনে করা হয়।
শালগ্রাম শিলার পূজায় প্রাণপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয় না, কারণ তিনি স্বতঃই দিব্যশক্তি সম্পন্ন। শালগ্রাম শিলার স্নান একটি নিত্যকর্ম।
- নিয়ম: শালগ্রাম শিলাকে প্রতিদিন তুলসী পাতা মিশ্রিত জল দিয়ে স্নান করানো হয়।
- মন্ত্র: “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” হল প্রধান মন্ত্র।
- চরণামৃতের গুরুত্ব: শালগ্রাম শিলাকে স্নান করানো জলই হল প্রকৃত ‘চরণামৃত’। পদ্ম পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণ-এর মতো শাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ভক্তিভরে শালগ্রাম শিলার চরণামৃত পান করেন, তিনি সকল পাপ থেকে মুক্ত হন এবং অন্তিমে বিষ্ণুলোক (বৈকুণ্ঠ) প্রাপ্ত করেন।
- তুলসীর আবশ্যকতা: শালগ্রাম শিলার পূজায় তুলসী পাতা ছাড়া কোনো পূজাই সম্পূর্ণ হয় না।
স্নানের উপাদানের প্রতীকী অর্থ
পঞ্চামৃতের প্রতিটি উপাদানের একটি গভীর প্রতীকী অর্থ রয়েছে যা জীবনের বিভিন্ন দিককে তুলে ধরে।
| উপাদান | প্রতীকী অর্থ | আধ্যাত্মিক তাৎপর্য |
| দুগ্ধ (Milk) | শুদ্ধতা, মঙ্গল | মনকে বিশুদ্ধ ও সাত্ত্বিক করা |
| দধি (Curd) | সমৃদ্ধি, পুষ্টি | জীবনে পারমার্থিক ও জাগতিক পুষ্টি লাভ |
| ঘৃত (Ghee) | জ্ঞান, শক্তি, বিজয় | জ্ঞানের আলো জ্বালানো, আসক্তি দূর করা |
| মধু (Honey) | মাধুর্য, ঐক্য, আনন্দ | জীবনে ও বাক্যে মিষ্টতা আনা, পরম আনন্দ লাভ |
| শর্করা (Sugar) | সুখ, তৃপ্তি | জীবনের চূড়ান্ত সুখ বা মোক্ষ প্রাপ্তি |
এই পাঁচটি উপাদান দিয়ে ভগবানকে স্নান করানোর অর্থ হল, আমাদের জীবনের এই সমস্ত ইতিবাচক দিকগুলি প্রথমে ভগবানকে অর্পণ করা এবং তারপর তাঁর প্রসাদ হিসেবে তা ফিরিয়ে নেওয়া।
বিশেষ তিথি ও বিষ্ণু স্নানের মহিমা
যদিও প্রতিদিন বিষ্ণু স্নান করানো একটি উত্তম অভ্যাস, কিছু বিশেষ তিথিতে এর গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
একাদশী ও পূর্ণিমা
প্রতি মাসের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি ভগবান বিষ্ণুর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এই দিনে বহু ভক্ত উপবাস রাখেন এবং বিশেষ অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পূর্ণিমা তিথিও বিষ্ণু (সত্যনারায়ণ) পূজার জন্য অত্যন্ত শুভ।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী
জন্মাষ্টমী হল ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি। এই দিন মধ্যরাতে সারা বিশ্বের মন্দিরগুলিতে এবং গৃহে গৃহে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যরূপ ‘লাড্ডু গোপাল’-এর মহাসমারোহে অভিষেক করা হয়। এই অভিষেক সাধারণত পঞ্চামৃত, ফলের রস এবং বিভিন্ন ভেষজ মিশ্রিত জল দিয়ে সম্পন্ন হয়।
স্নান যাত্রা: অভিষেকের এক মহোৎসব
বিষ্ণু অভিষেকের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উদাহরণ হল পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ‘স্নান যাত্রা’ (Snana Yatra) বা ‘দেবস্নান পূর্ণিমা’। ভগবান জগন্নাথকে শ্রীকৃষ্ণের (বিষ্ণুর) একটি রূপ হিসেবেই পূজা করা হয়।
এটি জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় এবং একে ভগবান জগন্নাথের ‘জন্মদিন’ বলে মনে করা হয়।
বাস্তব তথ্য ও পরিসংখ্যান (Real-time Data & Statistics):
- উৎপত্তি: স্কন্দ পুরাণ (Skanda Purana) অনুসারে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রথমবার পুরীতে বিগ্রহ স্থাপনের সময় এই স্নান যাত্রার প্রবর্তন করেছিলেন।
- ১০৮ কলস জল: এই অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হল ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং দেবী সুভদ্রাকে ১০৮ টি কলস ভর্তি সুগন্ধি জল দিয়ে স্নান করানো হয়।
- সোনা কুয়া (Golden Well): এই ১০৮ কলস জল মন্দিরের ভেতরের একটি নির্দিষ্ট কূপ থেকে সংগ্রহ করা হয়, যা ‘সোনা কুয়া’ বা স্বর্ণকূপ নামে পরিচিত। এই কূপের জল শুধুমাত্র এই দিনেই ব্যবহৃত হয়।
- জলের বিভাজন: প্রথা অনুযায়ী, এই ১০৮ কলস জলের মধ্যে ৩৫টি কলস ভগবান জগন্নাথকে, ৩৩টি কলস ভগবান বলভদ্রকে, ২২টি কলস দেবী সুভদ্রাকে এবং ১৮টি কলস শ্রীসুদর্শনকে স্নানের জন্য ব্যবহৃত হয়। [সূত্র: শ্রী জগন্নাথ টেম্পল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (SJTA), পুরী-এর অফিসিয়াল প্রথা]
- মন্ত্রোচ্চারণ: এই স্নান বৈদিক মন্ত্র, বিশেষত পুরুষ সূক্ত এবং পবমান সূক্ত পাঠের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
- হস্তী বেশ (Hati Vesha): স্নানের পর, বিশ্বাস করা হয় যে অতিরিক্ত স্নানের ফলে দেবতারা ‘জ্বরে’ আক্রান্ত হন। তখন তাঁদের সাধারণ ভক্তদের থেকে আড়ালে রাখা হয় এবং তাঁদের ‘হস্তী বেশ’ বা ‘গণেশ বেশ’ (হাতির মতো) সাজানো হয়।
- অনসর (Anasara): এই স্নান যাত্রার পর থেকে রথযাত্রার আগের দিন পর্যন্ত প্রায় ১৫ দিন ভগবানকে ‘অনসর ঘর’ (অসুস্থ থাকার ঘর) নামক একটি ব্যক্তিগত কক্ষে রাখা হয়। এই সময় সাধারণ দর্শনার্থীরা তাঁদের দর্শন পান না। [সূত্র: ISKCON এবং পুরী মন্দিরের প্রথা] এই সময় দেবতাদের ভেষজ চিকিত্সা এবং বিশেষ ‘পন ভোগ’ (Pana Bhoga) নিবেদন করা হয়।
এই স্নান যাত্রা প্রমাণ করে যে, দেবতার অভিষেক কেবল একটি আচার নয়, এটি ভগবানের সাথে এক জীবন্ত, প্রেমময় এবং মানবিক সম্পর্কের উদযাপন।
অভিষেকের দর্শন: নিছক আচারের বাইরে
বিষ্ণু স্নানের মন্ত্র ও পদ্ধতি জানা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর পেছনের দর্শন বা ভাবটি বোঝা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি হিন্দুধর্মের ‘কর্মকাণ্ড’ (আচার-অনুষ্ঠান) এবং ‘ভক্তিযোগ’ (প্রেমের মাধ্যমে সংযোগ) – এই দুইয়ের এক অপূর্ব মিলন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক, তিনি জটিল আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও শুদ্ধ ভক্তি এবং নামকীর্তনের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বা “হরে কৃষ্ণ” মহামন্ত্র—যেকোনো একটি মন্ত্র যদি আন্তরিক প্রেম ও ভক্তির সাথে জপ করা হয়, তা হাজারও জটিল বৈদিক অভিষেকের সমান ফল দিতে পারে।
সুতরাং, যখন একজন ভক্ত ভগবানকে স্নান করান, তখন তিনি কেবল একটি প্রথা পালন করছেন না। তিনি ভাবছেন: “হে প্রভু, আমি আমার সীমিত সামর্থ্য দিয়ে আপনার সেবা করছি। যেমন এই জল আপনার বিগ্রহকে শুদ্ধ করছে, তেমনি আপনার কৃপা আমার মন, আমার অহংকার এবং আমার পাপকে ধুয়ে শুদ্ধ করুক।”
নাসিক সিংহস্থ কুম্ভ মেলার তারিখ ঘোষণা: ২১ মাসের দীর্ঘতম মেলার প্রস্তুতি শুরু
এই ভাবটিই হল আসল মন্ত্র।
স্নানের উপকারিতা এবং যা এড়িয়ে চলা উচিত
শাস্ত্র এবং ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে, নিয়মিত বিষ্ণু বা শালগ্রাম শিলার অভিষেক করলে জীবনে বহু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
আধ্যাত্মিক ও মানসিক উপকারিতা:
১. মনের শুদ্ধি: মন্ত্রের ধ্বনি এবং সেবার কাজ মনকে স্থির করে, নেতিবাচক চিন্তা দূর করে এবং মানসিক শান্তি আনে।
২. ভক্তি বৃদ্ধি: প্রতিদিনের সেবার মাধ্যমে ভগবানের প্রতি একটি গভীর ব্যক্তিগত ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়।
৩. গ্রহের দোষ খণ্ডন: জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করা হয়, শালগ্রাম শিলার অভিষেক করলে গ্রহজনিত বাধা-বিপত্তি প্রশমিত হয়।
৪. পারিবারিক শান্তি: যে গৃহে প্রতিদিন ভগবানের অভিষেক ও পূজা হয়, সেখানে ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার হয় এবং পারিবারিক কলহ হ্রাস পায়।
যা এড়িয়ে চলা উচিত (Common Mistakes):
- অশুদ্ধতা: অপরিষ্কার হাতে বা স্নান না করে পূজা করা উচিত নয়।
- তুলসীর অভাব: বিষ্ণু পূজায় তুলসী পাতা বাদ দেওয়া একটি বড় ত্রুটি।
- বাসি জল: পূজার জন্য সর্বদা টাটকা এবং শুদ্ধ জল ব্যবহার করা উচিত।
- অশ্রদ্ধা: তাড়াহুড়ো করে বা মনঃসংযোগ ছাড়া যান্ত্রিকভাবে পূজা করা উচিত নয়। ভক্তিই প্রধান।
- নখ স্পর্শ: বিগ্রহ বা শালগ্রামকে নখ দিয়ে স্পর্শ করা উচিত নয়।
সেবার মাধ্যমে পরম প্রাপ্তি
বিষ্ণু স্নানের মন্ত্র “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” হতে পারে সহজ, কিন্তু এর পেছনের প্রক্রিয়া এবং দর্শন অত্যন্ত গভীর। এটি একটি সাধারণ কাজকে অসাধারণ ভক্তিমূলক অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে। পঞ্চামৃতের প্রতিটি কণা, জলের প্রতিটি ধারা এবং মন্ত্রের প্রতিটি অক্ষর ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি করে।
আপনি জটিল বৈদিক মন্ত্র পাঠ করুন বা কেবল সরল মনে “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” বলে এক গ্লাস জল ও একটি তুলসী পাতা অর্পণ করুন, ভগবান বিষ্ণু আপনার সেবার পেছনের ‘ভাব’ বা ‘আবেগ’-কেই গ্রহণ করেন। এই নিঃস্বার্থ সেবাই হল জীবনে প্রকৃত শান্তি, আনন্দ এবং আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভের সহজতম পথ।











