Vitamin Deficiency Diseases: বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও প্রকট। ভিটামিনের অভাবে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ে। তাই কোন ভিটামিনের অভাবে কী রোগ হয় তা জানা অত্যন্ত জরুরি।
ভিটামিন A এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি দিনের বেলায় স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারলেও রাতের বেলায় দেখতে অসুবিধা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে এটি স্থায়ী অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫০ মিলিয়ন শিশু ভিটামিন A এর অভাবে ভুগছে।
ভিটামিন B1 বা থায়ামিনের অভাবে বেরি-বেরি রোগ হয়। এই রোগে পেশী দুর্বল হয়ে যায় এবং ওজন কমে যায়। গুরুতর ক্ষেত্রে এটি পক্ষাঘাত ও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে চাল খাওয়া দেশগুলোতে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
ভিটামিন B12 এর অভাবে পারনিশিয়াস অ্যানিমিয়া হয়। এতে রক্তের লাল কণিকার সংখ্যা কমে যায় এবং স্নায়বিক সমস্যা দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে প্রায় ৫৩% মানুষ ভিটামিন B12 এর অভাবে ভুগছে।
Dengue: ৫টি অবাক করা ঘরোয়া কৌশলে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়াকে দিন চ্যালেঞ্জ!
ভিটামিন C এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। এতে মাড়ি ফুলে যায়, দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায় এবং ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ১৮শ শতাব্দীতে নাবিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যেত।
ভিটামিন D এর অভাবে রিকেটস রোগ হয়। এতে হাড় নরম হয়ে যায় এবং বাঁকা হয়ে যায়। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে প্রায় ৬১% মানুষ ভিটামিন D এর অভাবে ভুগছে।
বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ ডা. সুদীপ্ত রায় বলেন, “ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে সুষম খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস খেতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে।”
কোন ভিটামিনের অভাবে উচ্চতা বাড়ে না – গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের প্রকোপ কমাতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন – ভিটামিন A ক্যাপসুল বিতরণ, আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, গর্ভবতী মায়েদের আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ ইত্যাদি। এসব কার্যক্রমের ফলে গত কয়েক বছরে ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের প্রকোপ কিছুটা কমেছে।
তবে এখনও অনেক দেশেই ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর প্রকোপ বেশি। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা জরুরি।
নিচের টেবিলে বিভিন্ন ভিটামিনের অভাবে কী কী রোগ হয় তা দেখানো হলো:
ভিটামিন | অভাবজনিত রোগ |
---|---|
A | রাতকানা, জেরোফথালমিয়া |
B1 | বেরি-বেরি |
B2 | চেইলোসিস, স্টোমাটাইটিস |
B3 | পেলাগ্রা |
B6 | অ্যানিমিয়া, ডারমাটাইটিস |
B12 | পারনিশিয়াস অ্যানিমিয়া |
C | স্কার্ভি |
D | রিকেটস, অস্টিওমালেশিয়া |
E | নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার |
K | রক্তপাত |
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:
১. প্রতিদিন বিভিন্ন রঙের ফলমূল ও শাকসবজি খান।
২. নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম, দুধ খান।
৩. সূর্যের আলোতে কিছুক্ষণ থাকুন।
৪. প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট নিন।
৫. ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন।
৬. নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম নিন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো ভিটামিনের অভাবে ভুগছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রকোপ রয়েছে ভিটামিন A, D ও B12 এর। বিশেষ করে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি।
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এতে তাদের শিক্ষাগ্রহণ ক্ষমতা কমে যায় এবং ভবিষ্যতে কর্মক্ষমতাও কমে যায়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) হিসাব অনুযায়ী, ভিটামিনের অভাবজনিত রোগের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, চিকিৎসা ব্যয় ও মৃত্যুজনিত ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের জাতীয় পুষ্টি সেবা (NNS) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ২০.৫% শিশু ভিটামিন A এর অভাবে ভুগছে। এছাড়া প্রায় ৪০% গর্ভবতী মহিলা ভিটামিন D এর অভাবে ভুগছেন।
বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, “শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য ভিটামিনের ভূমিকা অপরিসীম। তাই শিশুদের খাবারে বিভিন্ন রঙের ফলমূল ও শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত ভিটামিন A ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে।”
ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমন – স্কুলে মিড-ডে মিল প্রোগ্রাম, গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের পুষ্টি সহায়তা, কৃষি বিভাগের মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন ইত্যাদি।
তবে এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। মানুষকে বুঝাতে হবে যে, ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধযোগ্য। সুষম খাবার খেলে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
পরিশেষে বলা যায়, ভিটামিনের অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। প্রতিটি মানুষকে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।