ভিটামিন কে: রক্ত তঞ্চনের অদৃশ্য নায়ক

Debolina Roy 4 Min Read

Vitamin K and bone health: রক্ত তঞ্চন একটি প্রাণরক্ষাকারী প্রক্রিয়া যেখানে ভিটামিন কে (Vitamin K) মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই ভিটামিনের অভাবে ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাত বন্ধ হতে চায় না, অথচ এর সঠিক মাত্রা শরীরে থাকলে জীবনহানিকর রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ সম্ভব। চলুন জানা যাক কীভাবে এই পুষ্টি উপাদানটি আমাদের রক্তজমাট প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর অভাবজনিত সমস্যাগুলো কী।

ভিটামিন কে কী এবং কীভাবে কাজ করে?

ভিটামিন কে একটি চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন যা প্রধানত দুটি রূপে পাওয়া যায়:

  1. ফাইলোকুইনোন (Vitamin K1): সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, ব্রকলি, কেল এতে প্রচুর থাকে
  2. মেনাকুইনোন (Vitamin K2): প্রাণীজ খাবার, ডিমের কুসুম ও গাঁজানো খাদ্য (যেমন ন্যাটো) এ বিদ্যমান

শুষ্ক ত্বকের জন্য দায়ী ৫টি ভিটামিনের অভাব – আপনার ত্বক কি শুকনো ও নিষ্প্রভ?

রক্তজমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা:

  • লিভারে উৎপন্ন কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর (II, VII, IX, X) সক্রিয় করতে ভিটামিন কে অপরিহার্য
  • এটি প্রোথ্রোমবিন নামক প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে যা ফাইব্রিনোজেনকে ফাইব্রিনে রূপান্তরিত করে রক্তজমাট তৈরি করে
  • অস্টিওক্যালসিন প্রোটিন সক্রিয় করে হাড়ের ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়ায়, হাড় মজবুত রাখে

ভিটামিন কে-এর উৎস ও দৈনিক চাহিদা

খাদ্যতালিকায় ভিটামিন কে-এর উল্লেখযোগ্য উৎস:

খাদ্য (আধা কাপ রান্না) ভিটামিন কে পরিমাণ (মাইক্রোগ্রাম)
কেল ৫৬৫
পালং শাক ৫৩০
ব্রাসেলস স্প্রাউট ৪৪৪
ব্রোকলি ২২০
সয়াবিন তেল ১০০ (প্রতি টেবিল চামচ)

বয়সভিত্তিক দৈনিক চাহিদা:

  • প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ: ১২০ মাইক্রোগ্রাম
  • প্রাপ্তবয়স্ক নারী (গর্ভাবস্থা সহ): ৯০ মাইক্রোগ্রাম
  • নবজাতক: ২-২.৫ মাইক্রোগ্রাম (জন্মের পর ইনজেকশন দেওয়া হয়)

ভিটামিন কে-এর অভাবজনিত সমস্যা

  1. হেমোরেজিক ডিজিজ: নবজাতকের মধ্যে ভিটামিন কে-এর অভাবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা পাচনতন্ত্র থেকে রক্তপাত হতে পারে
  2. অস্টিওপোরোসিস: হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া
  3. অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: ছোট কাটাছেঁড়াতেও রক্ত বন্ধ হতে বেশি সময় লাগা

ঝুঁকিতে যারা:

  • ক্রোন’স ডিজিজ, সেলিয়াক রোগে আক্রান্তরা
  • লিভার সিরোসিস বা পিত্তথলির অসুখ থাকলে
  • দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকারী

ওয়ারফারিন ও ভিটামিন কে-এর সম্পর্ক

রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন ওয়ারফারিন) সেবনকারীদের ভিটামিন কে সমৃদ্ধ খাবার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কারণ:

  • হঠাৎ করে বেশি ভিটামিন কে গ্রহণ করলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যায়
  • প্রতিদিন স্থির পরিমাণ সবুজ শাক খাওয়া উচিত (যেমন দিনে ১ কাপের বেশি নয়)

রক্ত তঞ্চনের বিজ্ঞান: ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া

রক্তজমাট বাঁধার এই জটিল প্রক্রিয়ায় ভিটামিন কে যেভাবে সাহায্য করে:

ধাপ ১: ক্ষতস্থানে অণুচক্রিকা জমা হয়ে প্রাথমিক প্লাগ তৈরি করে।
ধাপ ২: ভিটামিন কে-নির্ভর কোয়াগুলেশন ক্যাসকেড সক্রিয় হয়:

  • ফ্যাক্টর II (প্রোথ্রোমবিন) → থ্রোমবিন
  • ফাইব্রিনোজেন → ফাইব্রিন তন্তু

ধাপ ৩: ফাইব্রিন জালিকায় রক্তকণিকা আটকে শক্ত জমাট তৈরি

ভিটামিনের অভাবে মারাত্মক রোগ: জেনে নিন কোন ভিটামিনের অভাবে কী রোগ হয়

কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টরগুলির তালিকা:

ফ্যাক্টর নং নাম
II প্রোথ্রোমবিন
VII প্রোকনভার্টিন
IX ক্রিসমাস ফ্যাক্টর
X স্টুয়ার্ট-প্রাওয়ার

বিশেষ পরামর্শ

  • নবজাতকের ক্ষেত্রে জন্মের ৬ ঘণ্টার মধ্যে ভিটামিন কে ইনজেকশন দেওয়া বাধ্যতামূলক
  • অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ওষুধ সেবনকালে রক্তের PT/INR পরীক্ষা নিয়মিত করান
  • হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিটামিন কে-সমৃদ্ধ খাবারের সাথে ভিটামিন ডি যুক্ত করুন

রক্ততঞ্চন থেকে হাড়ের স্বাস্থ্য—প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিটামিন কে-এর অবদান অপরিসীম। একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে এর ঘাটতি এড়ানো সহজ। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত সবুজ শাক খাওয়া যেমন সমস্যা তৈরি করতে পারে, তেমনি একেবারেই বর্জনও বিপজ্জনক।

Share This Article