Srijita Chattopadhay
২২ জুন ২০২৪, ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন সংস্করণ

মিছিলের গর্জন, ভোট বাক্সে নীরবতা: বামপন্থীদের সংকটময় রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ

Voter Apathy Amid CPIM Rallies

পশ্চিমবঙ্গে  রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে একটি বিস্ময়কর বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদিকে বামপন্থী দলগুলো বড় বড় সমাবেশ ও মিছিল করতে সক্ষম হচ্ছে, অন্যদিকে নির্বাচনে তাদের ফলাফল হতাশাজনক। এই বিরোধাভাস বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

মিটিং ও মিছিলে জনসমাগম

বামপন্থী দলগুলো এখনও বড় সমাবেশ আয়োজন করতে সক্ষম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের আয়োজিত বিভিন্ন সমাবেশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ব্রিগেডে বাম ছাত্র যুব সংগঠন সমাবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল। এই ধরনের সমাবেশগুলো বামপন্থী দলগুলোর সংগঠন ক্ষমতা এবং জনগণের মধ্যে তাদের আবেদনের প্রমাণ দেয়।

জনগণের এই সমাবেশে যোগদানের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

  • প্রথমত, বামপন্থী দলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার, যা এখনও অনেকের কাছে আকর্ষণীয়।
  • দ্বিতীয়ত, তারা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার আদর্শ তুলে ধরে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সমর্থন পায়।
  • তৃতীয়ত, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি হতাশা থেকে অনেকে বিকল্প রাজনীতির আশায় বামপন্থী সমাবেশে যোগ দেন।

ভোটবাক্সে প্রতিফলনের অভাব

যদিও বামপন্থী দলগুলো বড় সমাবেশ করতে পারে, কিন্তু এই জনসমর্থন ভোটে রূপান্তরিত হচ্ছে না। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দিন এগোনোর সাথে সাথে রক্তক্ষরণ বেড়েছে। ইস্যু ভিত্তিক সমর্থন পেলেও অন্যান্য দলের প্রার্থী তুলনায় ভোটবাক্স গড়ের মাঠে পরিণত হয়েছে।। এই ফলাফল বামপন্থী দলগুলোর জন্য উদ্বেগজনক, কারণ এটি তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রাসঙ্গিকতার অবনতি নির্দেশ করে।

ভোটারদের মনোভাব পরিবর্তনের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে:

  1. আদর্শগত সংকট: অনেক ভোটার মনে করেন যে বামপন্থী আদর্শ বর্তমান বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, ইতিমধ্যে কংগ্রেসের সাথে জোট বেঁধে ভোটের ময়দানে নামছে তারা। এক সময়ে সাপে নেউলে থাকা রাজনৈতিক দল একসাথে ভোট যুদ্ধে নামতে দেখে সাধারণ মানুষদের অধিকাংশ ভালোভাবে দেখছে না.
  2. দুর্বল প্রার্থী: অনেক ক্ষেত্রে বামপন্থী দলগুলো শক্তিশালী ও জনপ্রিয় প্রার্থী উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
  3. কার্যকর কর্মসূচির অভাব: ভোটাররা মনে করেন বামপন্থী দলগুলো বাস্তবসম্মত ও কার্যকর নীতিমালা প্রস্তাব করতে পারেনি।
  4. মূলধারার দলগুলোর প্রভাব: বড় দলগুলোর সংগঠন ও সম্পদের তুলনায় বামপন্থী দলগুলো পিছিয়ে পড়েছে।

রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার সংকট

বামপন্থী দলগুলো বর্তমানে তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীর সংকটে রয়েছে। সমকালীন ইস্যুগুলোতে তাদের অবস্থান প্রায়শই স্পষ্ট নয় বা জনগণের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, বা বৈশ্বিক বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলোতে তাদের অবস্থান প্রায়শই অস্পষ্ট বা পুরনো ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

বিশেষ করে যুব সমাজের কাছে বামপন্থী আদর্শের আবেদন কমে যাচ্ছে। কিছুদিন আগের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮-৩৫ বছর বয়সী মাত্র ৩০% ভোটার বামপন্থী দলগুলোর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। এটি একটি উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান, কারণ যুব সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

বামপন্থী আদর্শের পুনর্মূল্যায়ন

বর্তমান সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থী আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যদিও সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমিকের অধিকার, ও সমতার মতো মূল আদর্শগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক, কিন্তু এগুলোকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।

উদাহরণস্বরূপ, শ্রমিকের অধিকারের ধারণাকে গিগ ইকোনমি ও রিমোট ওয়ার্কের যুগে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। একইভাবে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য নতুন কৌশল প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা

বামপন্থী দলগুলোর জন্য ভবিষ্যতে টিকে থাকতে হলে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

  1. দলীয় সংস্কার: পুরনো ধ্যান-ধারণা ও কাঠামো পরিবর্তন করে আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম একটি সংগঠন গড়ে তোলা।
  2. নতুন নেতৃত্ব: যুব ও প্রগতিশীল নেতাদের সামনে আনা, যারা নতুন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসবেন।
  3. আধুনিক নীতিমালা: বর্তমান সমস্যাগুলোর সমাধানে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন।
  4. ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার: সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যুব সমাজের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো।
  5. সহযোগিতামূলক রাজনীতি: অন্যান্য প্রগতিশীল দল ও সংগঠনের সাথে জোট গঠন।

 বামপন্থী রাজনীতি এখন সন্ধিক্ষণে। মিটিং-মিছিলে জনসমর্থন থাকলেও ভোটবাক্সে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে হলে বামপন্থী দলগুলোকে নিজেদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে এবং সময়োপযোগী পরিবর্তন আনতে হবে। তবেই তারা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইউনুসের ‘নতুন’ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঊর্ধ্বগতি: রাজপথে প্রতিবাদের ঝড় ছাত্রদের

ভারতে ইন্টারনেট বিপ্লবের নতুন দিগন্ত: স্টারলিঙ্কের সঙ্গে এয়ারটেলের ঐতিহাসিক চুক্তি

অস্ত্র আমদানির দৌড়ে শীর্ষে ইউক্রেন, ভারতের স্থান দ্বিতীয়: বিশ্বে কী বার্তা?

মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে নজর! বঙ্গের সব আসনে লড়তে প্রস্তুত আইএমআইএম

হোলির রঙে ব্যাঙ্ক বন্ধ: আগামীকাল থেকে টানা ৪ দিন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাঙ্ক ছুটি, তালিকা দেখে নিন

কেকেআরের প্রস্তুতি শুরু: কলকাতায় নাইটদের ক্যাপ্টেন-কোচের সঙ্গে প্রকাশিত হল প্র্যাক্টিস সূচি

শিক্ষামন্ত্রীর বাড়ির সামনে ‘ক্রিমিনাল’ পোস্টার: সিপিএম নেতার থানায় তলব!

কলকাতার Zakaria Street-এর মাস্ট ভিজিট ফুড স্টল: একটি খাদ্যপ্রেমীর স্বর্গভূমি

অলক্ষ্যে ঋত্বিক: ঋত্বিক ঘটকের জীবনালেখ্য নিয়ে আসছে বাঙালির প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র

আইপিএল-এ তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কড়া নির্দেশ জারি!

১০

দেওয়ালের কোন দিকে কোন রঙ শুভ? বাস্তুশাস্ত্রের চোখে একটি গভীর দৃষ্টিপাত

১১

ডিএলএফ-এমআরএফ-আমূল-পেটিএম: সংক্ষিপ্ত নামেই ভারত বিখ্যাত, এবার জেনে নিন এই ব্র্যান্ডগুলোর পুরো নাম!

১২

সেক্সসমনিয়া: ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরল রহস্য

১৩

ভীষণ ক্ষতিকর Non-Stick প্যানে রান্না করছেন না তো? জেনে নিন সেরা বিকল্পগুলো

১৪

কাক ডাকার ফলাফল: ইসলাম ও হিন্দু শাস্ত্রে কী বলা আছে?

১৫

দিনে ৮ ঘণ্টা AC চালালে মাসে কত ‘Electric Bill’ আসবে? সহজ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকুন

১৬

প্রাক্তনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কি বুদ্ধিমানের কাজ? একটি গভীর বিশ্লেষণ

১৭

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের জাদু: কীভাবে ভারত হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য?

১৮

বাংলার প্রথম এসি লোকাল ট্রেন শিয়ালদা-কৃষ্ণনগর রুটে, ভাড়া কত জানেন?

১৯

ভারতে রাজ্যভিত্তিক হীরার মজুদ: কোন রাজ্য হীরা উৎপাদনে সেরা?

২০
close