Impact of Waqf Amendment Act: ভারতের সংসদ ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বহুল আলোচিত ওয়াকফ সংশোধনী আইন পাস করেছে, যা এখন ‘উমিদ’ (UMEED – Unified Management Empowerment Efficiency and Development) আইন নামে পরিচিত। এই সংশোধনী মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে এবং বিরোধীরা একে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘনের একটি হাতিয়ার হিসাবে দেখছেন। সরকার দাবি করছে এটি স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়াবে, অন্যদিকে বিরোধীরা বলছেন – “বুলডোজার দিয়ে ভাঙার প্রয়োজন নেই, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করা যায়”।
ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রধান পরিবর্তনসমূহ
নামকরণের পরিবর্তন: এই আইনটির নাম পরিবর্তন করে “উমিদ” (UMEED) রাখা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘Unified Management Empowerment Efficiency and Development’।
ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তি: নতুন আইনে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম প্রতিনিধি নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন, কারণ এতদিন এই ধর্মীয় বোর্ডগুলিতে শুধুমাত্র মুসলিম সদস্যরাই থাকতেন।
‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বিধান বাতিল: পূর্বের আইনে যেখানে দীর্ঘদিন ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো, সেই বিধান এখন বাতিল করা হয়েছে। তবে এই আইন প্রণয়নের আগে রেজিস্ট্রিকৃত ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তিগুলো তাদের অবস্থান বজায় রাখবে, যদি না সেগুলো সরকারের সাথে বিবাদে জড়িত থাকে।
ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণে পরিবর্তন: আগে ওয়াকফ বোর্ড ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষমতা রাখত, কিন্তু নতুন আইনে এই বিধান বাতিল করা হয়েছে।
ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে: আগে বিশেষ সার্ভে কমিশনার নিয়োগ করা হতো, এখন জেলা কালেক্টরদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্য রাজস্ব আইন অনুসারে সার্ভে করতে হবে।
ট্রাইব্যুনালের গঠন পরিবর্তন: ওয়াকফ বিষয়ক বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনালে ইসলামিক আইন বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে রাজ্য সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা এবং মুসলিম আইন ও ইসলামিক ন্যায়শাস্ত্রের বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আপিলের বিধান: ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে মনে করার বিধান বাতিল করা হয়েছে। এখন ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ওয়াকফ বোর্ড: বোহরা, আগাখানি, শিয়া এবং সুন্নি সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা ওয়াকফ বোর্ড গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
মহিলাদের অধিকার: পারিবারিক ওয়াকফের ক্ষেত্রে মহিলাদের উত্তরাধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে, বিশেষ করে বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্ন এবং এতিম মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সরকারের যুক্তি: পারদর্শিতা ও দক্ষতার উন্নয়ন
সরকারের মতে, এই আইন সংশোধনের পিছনে যুক্তি হলো ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা আনয়ন করা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিলটি পাশ হওয়ার পর একে “একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে ওয়াকফ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে ভুগছে।
সরকার যুক্তি দিয়েছে যে:
-
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা দূর করা: ওয়াকফ বোর্ডগুলির পরিচালনায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রোধ করা।
-
সম্পত্তি বিবাদ কমানো: সম্পত্তি বিবাদ কমিয়ে এবং সঠিক নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করে সম্পত্তির সুরক্ষা বাড়ানো।
-
আইনি বিরোধ সমাধান সহজীকরণ: বিবাদ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সরলীকরণ করা।
সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা সরকারের জবাবে বলা হয়েছে, “আইন একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হয়েছে… সংসদের উভয় কক্ষে বিস্তৃত বিতর্কের পর।” সরকার আরও বলেছে, “সংসদের প্রণীত আইনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিকতার অনুমান প্রযোজ্য এবং অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ ক্ষমতার ভারসাম্যের নীতির বিরুদ্ধে।”
ওয়াকফ সম্পত্তির পরিসংখ্যান: চমকপ্রদ বৃদ্ধি
সরকারের দাখিল করা তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইন সংশোধনের পর দেশজুড়ে ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন জমির পরিমাণ ১১৬% বৃদ্ধি পেয়েছে5। এটি সরকারের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়েছে:
-
বর্তমানে দেশজুড়ে ওয়াকফ বোর্ডগুলির মালিকানাধীন সম্পত্তির সংখ্যা ৮,৭২,৮৭০টি, যার মোট আয়তন ৩৯,০২,৪৭৬.৩৫৬ একর।
-
২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা ছিল ২,০৭,৩৯৪টি, কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৬,৬৫,৪৭৬টি সম্পত্তি যুক্ত হয়েছে, যা ৩২০.৯% বৃদ্ধি।
-
২০১৩ সাল পর্যন্ত (যার মধ্যে মুঘল যুগ, স্বাধীনতা-পূর্ব যুগ এবং স্বাধীনতা-উত্তর যুগ অন্তর্ভুক্ত) ওয়াকফ সম্পত্তির মোট আয়তন ছিল ১৮,২৯,১৬৩.৮৯৬ একর। ২০১৩ সালের পর থেকে মাত্র ১১ বছরে আরও ২০,৯২,০৭২.৫৬৩ একর জমি যুক্ত হয়েছে।
সমালোচকদের উদ্বেগ: ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে আঘাত
নতুন আইন সম্পর্কে বিরোধী দল, মুসলিম নেতা এবং বিভিন্ন সংগঠন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রধান আপত্তিগুলি হল:
ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন: সমালোচকরা যুক্তি দিচ্ছেন যে এই আইন সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে, বিশেষ করে ১৪, ২৫, ২৬ এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি: এই আইন ওয়াকফ সম্পত্তি এবং বিবাদ সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা প্রদান করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। এই পরিবর্তনকে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রদায়ের পরামর্শের অভাব: আইনটি মুসলিম স্টেকহোল্ডারদের সাথে পর্যাপ্ত পরামর্শের অভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে সমালোচনা করা হয়েছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডসহ অনেক সংগঠন তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা: “ওয়াকফ বাই ইউজার” বিধান বাতিল করায় ঐতিহাসিকভাবে ওয়াকফ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সম্পত্তি, যেগুলোর আনুষ্ঠানিক দলিল নেই, তার মর্যাদা বিপন্ন হতে পারে।
বিবাদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা: ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের কর্তৃত্ব বাতিল করে সম্পত্তি নির্ধারণের দায়িত্ব জেলা কালেক্টরদের হাতে দেওয়া বিবাদ বৃদ্ধি করতে পারে।
অমুসলিম প্রতিনিধিত্ব নিয়ে উদ্বেগ: ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচকরা যুক্তি দিচ্ছেন যে এটি বোর্ডের অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে, কারণ অমুসলিম সদস্যরা ইসলামি আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নাও রাখতে পারেন।
বর্তমান আইনি চ্যালেঞ্জ
ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫ সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং বিভিন্ন আবেদনকারী এর বিরোধিতা করছেন।
২১ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে, কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে যে তারা ওয়াকফ আইনের কয়েকটি বিধান, যেগুলো তারা পূর্বে সংসদে সমর্থন করেছিল, সেগুলো স্থগিত রাখছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘ওয়াকফ-বাই-ইউজার’ সম্পত্তি সংক্রান্ত ধারা এবং ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান।
সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে প্রশ্ন করেছে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে হিন্দু এনডাউমেন্ট বোর্ডগুলিতে মুসলমানদের অনুমতি দেওয়া হবে কিনা। আদালত সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, যার মধ্যে বাংলায় মৃত্যু এবং লখনউতে অশান্তির খবর রয়েছে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দেওয়ার কথা বিবেচনা করছিল।
অল পার্টিজ হুররিয়ত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান এবং শ্রীনগরের জামা মসজিদের প্রধান ধর্মযাজক মিরওয়াইজ উমর ফারুক ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে “মুসলিম পরিচয়ে আঘাত” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিক এবং ধর্মীয় অধিকার বজায় রাখবে এবং এই আইন বাতিল করবে।
ডিজিটাইজেশন এবং তথ্যের অসঙ্গতি
সরকারের দাবি সত্ত্বেও, সাংবাদিক আফরোজ আলম সাহিলের আরটিআই তদন্তে WAMSI পোর্টালের মাধ্যমে পরিচালিত ওয়াকফ ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ায় গুরুতর অসঙ্গতি প্রকাশ পেয়েছে। ৪,৩৫,০০০ সম্পত্তির তথ্য অনুপস্থিত ছিল, অর্থের বড় অংশ অব্যবহৃত ছিল, এবং কোনো অডিট করা হয়নি। সাহিল আরও সরকারি রেকর্ড এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে কবরস্থান এবং অন্যান্য সম্পত্তির অমিল সংখ্যা রয়েছে, যা স্বচ্ছতা, নির্ভুলতা এবং ডিজিটাইজেশন উদ্যোগের দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ তুলে ধরেছে।
ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সম্পত্তি পরিচালনায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সরকার এর পিছনে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং আধুনিকীকরণের যুক্তি দিলেও, এটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
যেখানে সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির হঠাৎ বৃদ্ধি এবং পরিচালনা সমস্যার উল্লেখ করছে, সেখানে সমালোচকরা এটিকে ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসন এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। এই আইনের ভবিষ্যৎ এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন, যা এর সাংবিধানিক বৈধতা নির্ধারণ করবে।
এই আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, আইনি শাসন এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে ধর্মীয় সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার এই প্রয়াস অনেকের কাছে “আমলাতন্ত্র বুলডোজারের বিকল্প হয়ে ওঠা”র মতো প্রতীয়মান হচ্ছে।যাই হোক, সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া, আন্দোলন এবং সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে এই আইনের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, এবং এটি ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং সম্পত্তি সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে বিবেচিত হবে।