Water can prevent what diarrhea can be prevented: গরমকাল হোক বা বর্ষা, পেটের সমস্যা যেন বাঙালির পিছু ছাড়ে না। আর পেটের সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ এবং বিরক্তিকর হলো ডায়রিয়া। এই সময়ে ঘন ঘন পাতলা পায়খানার কারণে শরীর একেবারে কাহিল হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে বড়দেরা প্রায়ই বলেন, “বেশি করে জল খাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, জল খেলে কি ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়? নাকি এটি একটি প্রচলিত ধারণা মাত্র? উত্তরটা আপনাকে কিছুটা অবাক করতে পারে। শুধু জল পান করলেই ডায়রিয়া আটকানো সম্ভব নয়, তবে ডায়রিয়া হলে জলই আপনার জীবন বাঁচাতে পারে। চলুন, এই বিষয়টি নিয়ে গভীরে আলোচনা করা যাক এবং এর পেছনের বিজ্ঞানটাকে সহজ ভাষায় বুঝে নেওয়া যাক।
এই আর্টিকেলে আমরা জানব, ডায়রিয়া কেন হয়, এর সাথে জলের সম্পর্ক ঠিক কতটা এবং কীভাবে আমরা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই রোগ থেকে নিজেদের এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।
ডায়রিয়া: একটি পরিচিত শত্রু
ডায়রিয়া আসলে কোনো রোগ নয়, বরং এটি বিভিন্ন রোগের একটি উপসর্গ। যখন আমাদের অন্ত্রে সংক্রমণ বা অন্য কোনো সমস্যা হয়, তখন শরীর দ্রুত সেই ক্ষতিকারক পদার্থকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলেই ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়, যাকে আমরা ডায়রিয়া বলি।
ডায়রিয়া কেন হয়? এর পেছনের কারণগুলো কী?
ডায়রিয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কিছু কারণ হলো:
- ভাইরাস সংক্রমণ: রোটাভাইরাস (Rotavirus) এবং নোরোভাইরাস (Norovirus) শিশুদের ডায়রিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এই ভাইরাসগুলো খুব সহজে একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- ব্যাকটেরিয়া এবং পরজীবী: দূষিত জল বা বাসি, পচা খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ই. কোলাই (E. coli), সালমোনেলা (Salmonella), এবং জিয়ার্ডিয়া (Giardia)-এর মতো ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী শরীরে প্রবেশ করে। এগুলো অন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে ডায়রিয়া শুরু হয়।
- খাবারে বিষক্রিয়া (Food Poisoning): অনেক সময় খাবারে থাকা বিষাক্ত উপাদান বা টক্সিন হজম প্রক্রিয়ায় গোলযোগ সৃষ্টি করে, যা থেকে তীব্র ডায়রিয়া এবং বমি হতে পারে।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এবং অন্যান্য ওষুধ অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে, যার ফলে হজমের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
- অন্যান্য শারীরিক সমস্যা: কিছু মানুষের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার হজম না হওয়া) বা অন্যান্য হজমজনিত রোগ (যেমন, ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ) থাকলেও ঘন ঘন ডায়রিয়া হতে পারে।
গরমে পেট ঠান্ডা রাখার ৭টি কার্যকরী ঘরোয়া উপায়
জল এবং ডায়রিয়ার সম্পর্ক: একটি গভীর বিশ্লেষণ
এবার আসা যাক আমাদের মূল প্রশ্নে—জল খেলে কি ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়? সহজ এবং সরাসরি উত্তর হলো, না। সাধারণ জল পান করে আপনি ভাইরাসের সংক্রমণ বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারবেন না। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো বিশুদ্ধ ও নিরাপদ জল এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
তবে ডায়রিয়া হয়ে গেলে জলের ভূমিকা আমূল বদলে যায়। তখন জল আর প্রতিরোধক থাকে না, হয়ে ওঠে জীবনরক্ষাকারী।
ডায়রিয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ: ডিহাইড্রেশন বা জলশূন্যতা
ডায়রিয়ার সময় ঘন ঘন পাতলা পায়খানা এবং বমির মাধ্যমে শরীর থেকে শুধু জলই নয়, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইডের মতো জরুরি লবণ বা ইলেকট্রোলাইটও বেরিয়ে যায়। এর ফলে শরীরে জলশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন তৈরি হয়।
ডিহাইড্রেশনের লক্ষণগুলো হলো:
- মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং প্রস্রাবের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া।
- তীব্র দুর্বলতা এবং মাথা ঘোরা।
- ত্বক খসখসে ও শুষ্ক হয়ে যাওয়া।
- শিশুদের ক্ষেত্রে চোখ বসে যাওয়া, কান্নার সময় জল না বের হওয়া এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঝিমিয়ে পড়া।
যদি সময়মতো শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ না করা হয়, তাহলে ডিহাইড্রেশন মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এর ফলে কিডনি বিকল হওয়া, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো তীব্র ডিহাইড্রেশন।
ডায়রিয়া হলে জল পান করা কেন জরুরি?
ডায়রিয়া চলাকালীন প্রচুর পরিমাণে জল ও অন্যান্য তরল পান করা আবশ্যক। কারণ এটি:
- শরীরকে সতেজ রাখে: শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া জলের ঘাটতি পূরণ করে ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে।
- ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য ফেরায়: সাধারণ জলের পাশাপাশি ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS) বা নুন-চিনির জল পান করলে শরীর হারানো লবণ ফিরে পায়, যা শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
- দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে: পর্যাপ্ত জল শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায় এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে।
সুতরাং, জল খেলে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায় না, কিন্তু ডায়রিয়া হলে পর্যাপ্ত জল ও তরল পান করা চিকিৎসার একটি অপরিহার্য অংশ।
পেটের চর্বি গলানোর ঘরোয়া উপায়: সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি
ডায়রিয়া প্রতিরোধের আসল উপায়: শুধু জল নয়, চাই আরও বেশি কিছু
যেহেতু জল পান করে ডায়রিয়া ঠেকানো যায় না, তাই আমাদের নজর দিতে হবে প্রতিরোধের আসল উপায়গুলোর দিকে। এর জন্য একটি সহজ সূত্র হলো WASH—Water (জল), Sanitation (পয়ঃনিষ্কাশন), এবং Hygiene (স্বাস্থ্যবিধি)।
১. নিরাপদ ও বিশুদ্ধ জল পান করুন
ডায়রিয়া প্রতিরোধের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো নিরাপদ জলের ব্যবহার নিশ্চিত করা।
- জল ফুটিয়ে পান করুন: জল অন্তত ১-২ মিনিট ফুটিয়ে নিলে এর মধ্যে থাকা বেশিরভাগ ক্ষতিকারক জীবাণু মারা যায়।
- ফিল্টার ব্যবহার করুন: একটি ভালো মানের ওয়াটার ফিল্টার জল থেকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ দূর করতে পারে।
- সিল করা বোতলের জল: ভ্রমণের সময় বা বাইরে থাকাকালীন নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ডের বোতলজাত জল পান করা নিরাপদ।
২. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন (Hygiene Practices)
স্বাস্থ্যকর অভ্যাস ডায়রিয়ার জীবাণুর সংক্রমণ অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারে।
- সঠিকভাবে হাত ধোয়া: এটি ডায়রিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর মধ্যে একটি। খাবার তৈরি করার আগে, খাওয়ার আগে, শৌচকর্মের পরে এবং শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন করার পরে অবশ্যই সাবান ও জল দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে হাত ধুতে হবে।
- খাবারের পরিচ্ছন্নতা:
- ফল এবং সবজি খাওয়ার আগে বিশুদ্ধ জল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
- মাংস, মাছ এবং ডিম ভালোভাবে রান্না করুন। অর্ধসিদ্ধ বা কাঁচা খাবার এড়িয়ে চলুন।
- রান্না করা খাবার বেশিক্ষণ বাইরে ফেলে রাখবেন না। প্রয়োজনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন এবং খাওয়ার আগে আবার গরম করে নিন।
- রান্নার জায়গা এবং বাসনপত্র পরিষ্কার রাখুন।
৩. উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা (Sanitation)
সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকলে মলমূত্রের জীবাণু খুব সহজে পরিবেশে এবং জলের উৎসে ছড়িয়ে পড়ে, যা থেকে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে।
- পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহার করুন।
- খোলা জায়গায় মলত্যাগ করা থেকে বিরত থাকুন।
- বাড়ি এবং আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন।
৪. টিকাকরণ (Vaccination)
শিশুদের ক্ষেত্রে রোটাভাইরাসের টিকা ডায়রিয়া প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। আপনার সন্তানের টিকাকরণের সময়সূচি অনুযায়ী সঠিক সময়ে এই টিকা দিন।
ডায়রিয়া হলে কী খাবেন এবং কী খাবেন না?
ডায়রিয়ার সময় শরীর খুব দুর্বল থাকে, তাই হজম করা সহজ এমন খাবার খাওয়া উচিত।
- কী খাবেন:
- ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS): এটি ডায়রিয়ার সেরা পথ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত ORS শরীরকে জল ও প্রয়োজনীয় লবণ সরবরাহ করে।
- ভাতের মাড়, ডাবের জল, পাতলা ডাল এবং স্যুপ: এগুলো শরীরকে শক্তি জোগায় এবং জলের ঘাটতি পূরণ করে।
- সহজপাচ্য খাবার: কলা, সেদ্ধ আলু, সাদা ভাত এবং টোস্ট (BRAT Diet) খাওয়া যেতে পারে।
- দই: এতে থাকা প্রোবায়োটিক অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
- কী এড়িয়ে চলবেন:
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: এগুলো হজম করা কঠিন হতে পারে (দই ছাড়া)।
- তেল-মশলাযুক্ত এবং ভাজা খাবার: এগুলো পেটের সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।
- মিষ্টি পানীয় ও ফলের রস: এগুলোতে চিনির পরিমাণ বেশি থাকায় ডায়রিয়া বাড়তে পারে।
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়: কফি, চা ইত্যাদি শরীরকে আরও ডিহাইড্রেটেড করে তুলতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?
সাধারণত ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়। তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত:
- ডায়রিয়া ২৪-৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চললে।
- তীব্র ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ (যেমন, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা) দেখা দিলে।
- মলের সাথে রক্ত বা শ্লেষ্মা বের হলে।
- তীব্র পেটব্যথা বা জ্বর থাকলে।
- শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তির ডায়রিয়া হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
শেষ কথা
তাহলে আলোচনার শেষে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম? জল খেলে কি ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়? না, সরাসরি প্রতিরোধ করা যায় না। ডায়রিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি হলো বিশুদ্ধ জল পান করা, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, এবং নিরাপদ খাবার গ্রহণ করা।
তবে ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে জল এবং ORS আপনার পরম বন্ধু। এটি শরীরকে জলশূন্যতার মতো মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা করে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে। তাই ডায়রিয়াকে অবহেলা না করে এর কারণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সচেতন হন এবং সুস্থ থাকুন। মনে রাখবেন, পরিচ্ছন্নতাই সুস্থতার চাবিকাঠি।