২০২৬-এর দামামা, কাল থেকেই বাংলায় কমিশনের বিশেষ ‘SIR’ সিস্টেম, এই ECI SIR Deployment ঘিরে তুঙ্গে জল্পনা

২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দামামা যেন এখনই বাজিয়ে দিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ হতে এখনও প্রায় ছয় থেকে সাত মাস বাকি, কিন্তু তার আগেই এক নজিরবিহীন পদক্ষেপে…

Avatar

 

২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের দামামা যেন এখনই বাজিয়ে দিল ভারতের নির্বাচন কমিশন। ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ হতে এখনও প্রায় ছয় থেকে সাত মাস বাকি, কিন্তু তার আগেই এক নজিরবিহীন পদক্ষেপে রাজ্যে বিশেষ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা (SIR) চালু করার কথা ঘোষণা করল কমিশন। আগামীকাল, অর্থাৎ ২৮ অক্টোবর, ২০২৫ থেকেই এই নতুন সিস্টেমের অধীনে বিশেষ দলগুলি তাদের কাজ শুরু করবে বলে নির্বাচন সদন সূত্রে খবর। কমিশনের এই আকস্মিক ECI SIR deployment ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজ্য রাজনীতিতে এবং প্রশাসনিক মহলে তীব্র জল্পনা শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের অতীতের নির্বাচনী হিংসা এবং সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখেই ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ বা আগাম পদক্ষেপের পথে হাঁটছে কমিশন। এই ‘SIR’ সিস্টেমকে প্রচলিত সাধারণ পর্যবেক্ষক (General Observers) বা পুলিশ পর্যবেক্ষক (Police Observers) নিয়োগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, কারণ তাঁরা নিযুক্ত হন নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অনেক বেশি কৌশলগত একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা।

কী এই ‘SIR’ ব্যবস্থা?

নির্বাচন কমিশনের অন্দরমহলের খবর অনুযায়ী, ‘SIR’-এর পুরো কথা হতে পারে ‘সিস্টেমেটিক ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টিং’ (Systematic Integrity Reporting)। এটি একটি প্রযুক্তি-নির্ভর, রিয়েল-টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা।

এর অধীনে, কমিশনের সচিবালয় স্তরের বা ডিরেক্টর স্তরের আধিকারিকদের নেতৃত্বে একাধিক ছোট, বিশেষ দল রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে। এই দলগুলি প্রথাগত প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে থেকে সরাসরি নির্বাচন সদনে (Nirvachan Sadan) রিপোর্ট করবে।

SIR টিমের প্রধান কাজ:

১. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আগাম মূল্যায়ন: এই দলগুলির প্রাথমিক কাজ হবে জেলা ধরে ধরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করা। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে একটি ‘রিস্ক অ্যানালিসিস’ রিপোর্ট তৈরি করবে।

২. ভোটার তালিকা সংশোধনীর ওপর নজরদারি: কাকতালীয়ভাবে, কাল থেকেই রাজ্যে ২০২৬ সালের চূড়ান্ত ভোটার তালিকার বিশেষ সংক্ষিপ্ত সংশোধনী (SSR) শুরু হচ্ছে। এই ‘SIR’ টিমগুলি সেই প্রক্রিয়ার ওপর কড়া নজর রাখবে, যাতে ভুয়ো নাম ঢোকানো বা আসল ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার মতো অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখা যায়।

৩. সংবেদনশীল বুথ ম্যাপিং: বিগত নির্বাচনগুলির তথ্যের ভিত্তিতে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে সংবেদনশীল ও অতি-সংবেদনশীল বুথগুলির প্রাথমিক ম্যাপিং শুরু করবে এই দলগুলি।

৪. ইভিএম প্রস্তুতি খতিয়ে দেখা: ফার্স্ট লেভেল চেকিং (FLC)-এর জন্য ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেশিনগুলির প্রস্তুতি এবং গুদামের পরিকাঠামো খতিয়ে দেখবে তারা।

কেন এত আগে এই পদক্ষেপ? তথ্য ও পরিসংখ্যান

নির্বাচন কমিশন সাধারণত ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর থেকে সক্রিয় হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই আগাম সক্রিয়তা রাজ্যের নির্বাচনী ইতিহাসেই নিহিত বলে মনে করা হচ্ছে।

১. বিগত নির্বাচনের হিংসার পরিসংখ্যান

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বরাবরই হিংসা-কবলিত বলে পরিচিত। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।

  • পরিসংখ্যান: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)-এর ২০২১ সালের ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া’ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশব্যাপী নির্বাচনী হিংসার ঘটনায় শীর্ষে। ওই বছর নির্বাচন-সম্পর্কিত দাঙ্গার (Rioting) ৬১টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল, যা ছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। (সূত্র: NCRB, Crime in India 2021 Report, Table 3A.5)

২. পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা

কেবল বিধানসভা নয়, ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ব্যাপক হিংসা, প্রাণহানি এবং বুথ দখলের অভিযোগ ওঠে, যা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি ভারতের নির্বাচন কমিশনেরও নজরে আসে। (সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, রয়টার্স, জুলাই ২০২৩)। এই লাগাতার হিংসার প্যাটার্নই কমিশনকে ২০২৬ সালের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক করে তুলেছে।

৩. ভোটার তালিকার স্বাস্থ্য

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম ধাপ হল একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা। ‘SIR’ দলগুলি যখন রাজ্যে পা রাখছে, ঠিক সেই সময়ই ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি-কে ভিত্তি তারিখ ধরে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হচ্ছে।

  • পরিসংখ্যান: পশ্চিমবঙ্গ মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (CEO) দপ্তর সূত্রে খবর, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত শেষ ভোটার তালিকা অনুযায়ী রাজ্যে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি ৬৫ লক্ষ। (সূত্র: CEO West Bengal Press Note, Feb 2025)। এই তালিকায় নতুন ১৮+ ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াটির ওপর ‘SIR’ টিমগুলির বিশেষ নজর থাকবে।

কমিশনের বার্তা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

যদিও ‘SIR’ সিস্টেম নিয়ে নির্বাচন কমিশন সরকারিভাবে বিশদ কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি, তবে কমিশনের শীর্ষকর্তারা বারবার বাংলায় ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলেছেন।

“আমরা একটি ১০০% মুক্ত, অবাধ, শান্তিপূর্ণ এবং প্রলোভনমুক্ত নির্বাচন উপহার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” — মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার (একটি পূর্ববর্তী সাংবাদিক বৈঠকে)। (সূত্র: ECI Press Conference, Oct 9, 2023)

কমিশনের এই নতুন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। দলের এক রাজ্য মুখপাত্রের মতে, “এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কমিশন সন্দিহান। আমরা চাই এই ‘SIR’ টিমগুলিকে যেন সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়।”

অন্যদিকে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস জানিয়েছে, তারা কমিশনের যে কোনও পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়। দলের এক বরিষ্ঠ নেতার কথায়, “নির্বাচন কমিশন তাদের কাজ করতেই পারে। রাজ্যের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। কিন্তু এই ব্যবস্থার নামে যেন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় হস্তক্ষেপ করা না হয়।”

এরপর কী? (What to Watch Next)

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘SIR’ সিস্টেমটি দুটি ধাপে কাজ করতে পারে:

  • প্রথম পর্যায় (অক্টোবর – ডিসেম্বর ২০২৫): মূলত তথ্য সংগ্রহ, ভোটার তালিকা পর্যবেক্ষণ এবং ঝুঁকির মূল্যায়ন।
  • দ্বিতীয় পর্যায় (জানুয়ারি – মার্চ ২০২৬): সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর রুট ম্যাপ তৈরি, স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে বিশেষ প্রশাসনিক রদবদলের সুপারিশ এবং চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রস্তুতির রূপরেখা তৈরি করা।

উপসংহারে বলা যায়, এই ‘SIR’ সিস্টেমের প্রবর্তন ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ‘বেঙ্গল মডেল’-এ একটি নতুন অধ্যায়। প্রথাগত পর্যবেক্ষণের বদলে এই ধরনের আগাম, প্রযুক্তি-নির্ভর এবং সরাসরি হস্তক্ষেপের মডেল যদি ২০২৬-এ সফল হয়, তবে তা আগামী দিনে দেশের অন্যান্য সংবেদনশীল রাজ্যগুলির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একটি মানদণ্ড হয়ে উঠতে পারে।

সম্পাদকের নোট (Editor’s Note)

এই প্রতিবেদনে ‘SIR’ (Systematic Integrity Reporting) সিস্টেম সম্পর্কিত তথ্যগুলি নতুন দিল্লির নির্বাচন সদনের নির্ভরযোগ্য সূত্রের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এখনও এই বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেনি। সিস্টেমের নামটি সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর কার্যপ্রণালী সম্পর্কিত বিবরণ প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম