ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক? পশ্চিমবঙ্গের চমকপ্রদ অবস্থান!

ভারতবর্ষের সামাজিক বাস্তবতার এক অন্ধকার দিক হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। আমরা প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে কিংবা ধর্মীয় স্থানগুলোতে অসংখ্য ভিক্ষুক দেখতে পাই। কিন্তু আপনি কি জানেন, ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা…

Chanchal Sen

 

ভারতবর্ষের সামাজিক বাস্তবতার এক অন্ধকার দিক হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। আমরা প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে কিংবা ধর্মীয় স্থানগুলোতে অসংখ্য ভিক্ষুক দেখতে পাই। কিন্তু আপনি কি জানেন, ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায়? সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আপনাকে অবাক করে দেবে। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো কোন রাজ্যে ভিক্ষুকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, কেন এমন পরিস্থিতি এবং এর পেছনের কারণগুলো কী।

পশ্চিমবঙ্গ: ভিক্ষুকের সংখ্যায় শীর্ষস্থানীয়

২০১১ সালের সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী, ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায় সেই প্রশ্নের উত্তর হলো পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে রাজ্যসভায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ভিক্ষুকের সংখ্যা ৮১,২৪৪ জন। এই সংখ্যা দিয়ে রাজ্যটি সমগ্র ভারতে প্রথম স্থান দখল করে আছে।

আরো চমকপ্রদ বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গে পুরুষের তুলনায় মহিলা ভিক্ষুকের সংখ্যা বেশি। রাজ্যে ৪৮,১৫৮ জন মহিলা ভিক্ষুক রয়েছে, অন্যদিকে পুরুষ ভিক্ষুকের সংখ্যা ৩৩,০৮৬ জন। এই পরিসংখ্যান দেশের লিঙ্গভিত্তিক দারিদ্র্যের একটি গভীর চিত্র তুলে ধরে।

সারাদেশের ভিক্ষুক পরিস্থিতি: একনজরে পুরো চিত্র

ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সমগ্র ভারতে মোট ভিক্ষুকের সংখ্যা ৪,১ৃ,৬৭০ জন। এর মধ্যে ২,২১,৬৭৩ জন পুরুষ এবং ১,৯১,৯৯৭ জন মহিলা ভিক্ষুক রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বিশাল সংখ্যার মধ্যে ৬১ হাজারেরও বেশি ভিক্ষুক রয়েছে যাদের বয়স ১৯ বছরের কম।

ভারতের মোট ভিক্ষাজীবী মানুষের প্রায় ২০ শতাংশই বসবাস করেন পশ্চিমবঙ্গে। এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং রাজ্যের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

রাজ্যওয়ারী ভিক্ষুকের তালিকা: কে কোথায়?

পশ্চিমবঙ্গের পর ভিক্ষুকের সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। এই রাজ্যে ভিক্ষুকের সংখ্যা ৬৫,৮৩৫ জন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, যেখানে ৩০,২১৮ জন ভিক্ষুক রয়েছে।

চতুর্থ স্থানে রয়েছে বিহার (২৯,৭২৩ জন), পঞ্চম স্থানে মধ্যপ্রদেশ (২৮,৬৯৫ জন) এবং ষষ্ঠ স্থানে রাজস্থান (২৫,৮৫৩ জন) রয়েছে। প্রথম দশের তালিকায় আরো রয়েছে মহারাষ্ট্র, অসম, ওড়িশা ও গুজরাত।

অন্যদিকে, সবচেয়ে কম ভিক্ষুক রয়েছে লাক্ষাদ্বীপে। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মাত্র ২ জন ভিক্ষুক রয়েছে। দাদরা নগর হাভেলিতে ১৯ জন, দমন ও দিউতে ২২ জন এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৫৬ জন ভিক্ষুক রয়েছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের ভিক্ষুক পরিস্থিতি

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে তুলনামূলকভাবে ভিক্ষুকের সংখ্যা কম। সিকিমে রয়েছে ৬৮ জন, অরুণাচল প্রদেশে ১১৪ জন, নাগাল্যান্ডে ১২৪ জন এবং মণিপুরে ২৬৩ জন ভিক্ষুক। মিজোরামে মাত্র ৫৩ জন, ত্রিপুরায় ১,৪৯০ জন, মেঘালয়ে ৩৯৬ জন এবং অসমে ২২,১১৬ জন ভিক্ষুক রয়েছে।

এই পরিসংখ্যান দেখায় যে উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্যগুলোতে ভিক্ষাবৃত্তির সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম। এর পেছনে হয়তো সম্প্রদায়িক বন্ধন, ঐতিহ্যবাহী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কম জনসংখ্যার ঘনত্ব দায়ী।

মেট্রো শহরগুলোতে ভিক্ষুকের অবস্থা

দেশের প্রধান মেট্রো শহরগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও উপেক্ষণীয় নয়। রাজধানী দিল্লিতে ২,১৮৭ জন এবং চণ্ডীগড়ে মাত্র ১২১ জন ভিক্ষুক রয়েছে। এই সংখ্যা শহুরে এলাকার উন্নত অর্থনৈতিক সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের প্রতিফলন ঘটায়।

তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, বড় শহরগুলোতে ভিক্ষাবৃত্তি অনেক সময় সংগঠিত অপরাধ চক্রের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে ভিক্ষাবৃত্তি একটি সংগঠিত অপরাধ নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে।

ভিক্ষাবৃত্তির পেছনের কারণগুলো

ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায় তার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এর মূল কারণ।

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, রাজ্যের ঘন জনসংখ্যা, শিল্পের অবক্ষয়, কৃষি সংকট এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। উপরন্তু, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন এবং বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত শ্রমিকদের একটি অংশ কাজের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভিক্ষাবৃত্তি সংক্রান্ত আইনি ব্যবস্থা

বর্তমানে ভারতে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য কোনো কেন্দ্রীয় আইন নেই। তবে ১৯৫৯ সালের বম্বে প্রিভেনশন অফ বেগিং অ্যাক্ট ২০টিরও বেশি রাজ্যে প্রযোজ্য। এমনকি রাজধানী দিল্লিতেও এই আইন বলবৎ রয়েছে।

এই আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধুমাত্র রাস্তায় ভিক্ষা করাই নয়, পাবলিক প্লেসে নাচ, গান, ছবি আঁকা বা কোনো প্রতিভা প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ নেওয়াকেও ‘ভিক্ষা’ হিসেবে ধরা হয়েছে।

রেলওয়ে আইনের ১৪৪ নং ধারা অনুযায়ী, রেলওয়ে স্টেশন বা প্ল্যাটফর্মে ভিক্ষা করা একটি অপরাধ। এই ধারায় দোষী প্রমাণিত হলে এক বছরের কারাদণ্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা কিংবা দুই-ই হতে পারে।

পুনর্বাসন প্রচেষ্টা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ভিক্ষাজীবী মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ১০টি শহরকে বেছে নিয়ে রাজ্য সরকারের সাথে যৌথ উদ্যোগে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, আমেদাবাদ, লখনউ, ইন্দোর, পাটনা এবং নাগপুরের নাম রয়েছে।

তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই তালিকায় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের কোনো শহরের নাম নেই। অথচ ভিক্ষুকের সংখ্যায় শীর্ষে থাকা রাজ্যের জন্য এমন প্রকল্প সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

ভারতের কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায় – এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট: পশ্চিমবঙ্গ। ৮১,২৪৪ জন ভিক্ষুক নিয়ে এই রাজ্য সারাদেশে শীর্ষে রয়েছে, যা মোট ভিক্ষুকের প্রায় ২০ শতাংশ। এই পরিস্থিতি শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্যই নয়, সমগ্র ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

ভিক্ষাবৃত্তির এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। শিক্ষার প্রসার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। শুধুমাত্র আইনি ব্যবস্থা নয়, বরং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা সমাধানে।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।