Buddhadeb Bhattacharya:পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্ন ও জমি অধিগ্রহণের নীতি নিয়ে উত্থাপিত বিতর্ক এবং তার পরিণতিতে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ২০০০ সালে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের উপর জোর দেন। কিন্তু ২০০৬-০৭ সালে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয় যা শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে বামফ্রন্টের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০০৬ সালে হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের নানো কার প্রকল্পের জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বুদ্ধদেব সরকার। এর বিরোধিতায় তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৬ দিনের ঐতিহাসিক অনশন শুরু করেন।
২০০৭ সালের মার্চে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামে একটি রাসায়নিক হাব স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব নেয় সরকার। এর বিরোধিতায় স্থানীয় কৃষকরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি (BUPC) গঠন করে। ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে ১৪ জন গ্রামবাসী নিহত হন, যা নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
“আমরা বুদ্ধবাবুর যোগ্য নই”, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে শোকাহত বাংলার শিল্পী সমাজ
এই দুটি ঘটনা বুদ্ধদেব সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দেয়। ২০০৮ সালের অক্টোবরে টাটা মোটরস সিঙ্গুর থেকে নানো প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে বুদ্ধদেব সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের নানো প্রকল্পের জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬৪৩ একর জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলেন। বাকি ৩৫৪ একর জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ নেননি।”
তিনি আরও বলেন, “SEZ প্রকল্পগুলো হাজার হাজার একর জমি চায়। প্রায় প্রতিটি শিল্পপতি হাজার হাজার একর জমি চাইছেন। কিন্তু সরকারের কাছে মাত্র ২২,০০০ একর অকৃষি জমি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।”
২০০৮ সালের মে মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদে প্রথমবারের মতো বিরোধীরা ৫৩টি আসনের মধ্যে ৩৫টিতে জয়লাভ করে।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট পরাজিত হয় এবং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনী প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় “মা মাটি মানুষ” স্লোগান ব্যবহার করেন এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ইস্যুকে প্রাধান্য দেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের আসন হারান এবং বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ফিরোজা বিবি ৩৯,৫৫১ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন।
এই ঘটনাগুলো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। জমি অধিগ্রহণ ও শিল্পায়নের নীতি নিয়ে জনমতের পরিবর্তন ঘটে। কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৩ সালে নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করে যাতে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পরবর্তীতে স্বীকার করেন, “আমরা জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল করেছিলাম। আমাদের উচিত ছিল কৃষকদের সাথে আরও বেশি আলোচনা করা।”
তবে তিনি মনে করেন, “শিল্পায়ন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু এটা করতে হবে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্ন ভালো হলেও তার বাস্তবায়নে ত্রুটি ছিল। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব এবং কৃষকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ না দেওয়া প্রধান সমস্যা ছিল।
অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু সরকারের উচিত ছিল কৃষকদের সাথে আরও বেশি সংলাপ করা এবং তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি চেয়েছিলেন। কিন্তু এর ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।”
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেই নয়, সারা ভারতে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে নতুন করে ভাবনার সূচনা করে। এর ফলে ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করে যাতে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্ন ও তার ব্যর্থতা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়:
১. শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
২. জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
৩. কৃষকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. শিল্পায়নের পাশাপাশি কৃষির উন্নয়নেও গুরুত্ব দিতে হবে।
৫. রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জনমতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
বুদ্ধদেবের অবস্থান
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্যবসা-বান্ধব নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা সিপিএম-এর ঐতিহ্যগত পুঁজিবাদ-বিরোধী অবস্থান থেকে আলাদা ছিল। তিনি মনে করতেন শিল্পায়ন ছাড়া রাজ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয়।কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা ও হিংসার অভিযোগের মুখে তাঁর সরকার চাপে পড়ে। এমনকি তাঁর মেন্টর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও তাঁকে সমালোচনা করেন, ২০১৩ সালে সিবিআই তদন্তে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর সরকারকে নন্দীগ্রাম গুলিচালনার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরেও বাম রাজনীতি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি।
সামগ্রিকভাবে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পায়নের স্বপ্ন ও তার পরিণতি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। এর প্রভাব আজও অনুভূত হয়। তবে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে উন্নয়নের পথে আরও সতর্কতার সাথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।