চাকরি প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে পশ্চিমবঙ্গ: অপেক্ষায় বেকার যুবসমাজ

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে বিরাজ করছে। তবে রাজ্যের যুবসমাজের কাছে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি - চাকরি সৃষ্টি - এখনও অধরাই রয়ে গেছে। এই ব্লগে…

Ishita Ganguly

 

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে বিরাজ করছে। তবে রাজ্যের যুবসমাজের কাছে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি – চাকরি সৃষ্টি – এখনও অধরাই রয়ে গেছে। এই ব্লগে আমরা পশ্চিমবঙ্গের চাকরি সংকট, তৃণমূল সরকারের ভূমিকা এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ

পশ্চিমবঙ্গে বেকার সমস্যা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 2022 সালে রাজ্যে বেকারত্বের হার ছিল 5.2%। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাস্তব চিত্র এর চেয়েও ভয়াবহ। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবছর 7 লক্ষ চাকরি সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা পূরণ হয়নি।

চাকরি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়:

  1. শিল্পায়নের ধীর গতি: সিঙ্গুর থেকে টাটা নানোর প্রস্থান এবং পরবর্তীতে বড় শিল্প প্রকল্প আকর্ষণে ব্যর্থতা রাজ্যের শিল্পায়নকে পিছিয়ে দিয়েছে।
  2. শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের অভাব: উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বিকাশের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
  3. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবহেলা: বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত।

চাকরি সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি

তৃণমূল সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি চাকরি সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি ঘটেছে, যা রাজ্যের চাকরি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে:

  1. শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি: প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত চলছে।
  2. সরকারি চাকরিতে স্বজনপোষণ: বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মন্ত্রী ও বিধায়কদের আত্মীয়-স্বজনদের অবৈধভাবে নিয়োগের তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে।
  3. মেধা তালিকা অগ্রাহ্য: বিভিন্ন সরকারি নিয়োগে মেধা তালিকা অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে।

এই ধরনের কেলেঙ্কারি যুব সমাজের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তারা মনে করছে, যোগ্যতা নয়, রাজনৈতিক যোগাযোগই চাকরি পাওয়ার একমাত্র উপায়।

যুবসমাজের প্রত্যাশা

পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ সরকারের কাছ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের আশা করছে:

  1. স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া: সরকারি ও বেসরকারি খাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
  2. দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি: শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
  3. শিল্প ও পরিষেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থান: বৃহৎ শিল্প স্থাপনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে উৎসাহিত করা।
  4. স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা নিজেরাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।

সম্ভাব্য সমাধান

পশ্চিমবঙ্গের চাকরি সংকট মোকাবেলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  1. শিল্প নীতির সংস্কার: শিল্প-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। জমি অধিগ্রহণ, শ্রম আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সংস্কার আনা।
  2. শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ: উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এবং শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সংশোধন করা।
  3. স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি: যুব উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ, পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান।
  4. দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ: নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে স্বাধীন কমিশন গঠন ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ।
  5. দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র: প্রতিটি জেলায় আধুনিক দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করে যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

যা না বললেই নয়

পশ্চিমবঙ্গের চাকরি সংকট একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কাছে এখন চ্যালেঞ্জ হলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও সুশাসন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যুবসমাজের ভবিষ্যৎ ও রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করছে এই সংস্কারের ওপর।

About Author
Ishita Ganguly

ঈশিতা গাঙ্গুলী ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে স্নাতক। তিনি একজন উদ্যমী লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ ও অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে থাকেন। ঈশিতার লেখার ধরন স্পষ্ট, বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যবহুল, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সামনে আনেন এবং পাঠকদের চিন্তা-চেতনার পরিসরকে বিস্তৃত করতে সহায়তা করেন। সাংবাদিকতার জগতে তার অটুট আগ্রহ ও নিষ্ঠা তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি দিয়েছে, যা তাকে ভবিষ্যতে আরও সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।