New credit card scheme in West Bengal: পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে রাজ্যের যুবক-যুবতীদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে ‘ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম’ চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী উদ্যোক্তারা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আমানতমুক্ত ঋণ পেতে পারেন। প্রকল্পের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে এই প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে এবং এই পরিমাণ খুব শীঘ্রই ১,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম কী?
‘ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি উদ্ভাবনী ধরণের প্রকল্প, যা রাজ্যের বেকার সমস্যা দূরীকরণ এবং তরুণ সম্প্রদায়কে স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল যুবক-যুবতীদের নিজেদের ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ এবং বস্ত্র দপ্তর (MSME&T Department) এই প্রকল্পের নোডাল বিভাগ হিসাবে কাজ করছে।
এই প্রকল্পটি ভারত সরকারের ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ডস ট্রাস্ট ফর মাইক্রো অ্যান্ড স্মল এন্টারপ্রাইজ’ (CGTMSE) এর সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, CGTMSE-এর অধীনে ভারত সরকার ঋণের ৮৫% গ্যারান্টি কভারেজ প্রদান করে, যেখানে বাকি ১৫% পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিয়ে থাকে। এই প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে তার সূচনার তারিখ থেকে ৫ বছরের জন্য (২০২৩-২০২৮) চালু থাকবে।
প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য ও সুবিধাসমূহ
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিমের অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হল এর আমানতমুক্ত ঋণ ব্যবস্থা। সুবিধাভোগীদের কোনো জামিন বা সিকিউরিটি ডিপোজিট ছাড়াই ঋণ প্রদান করা হয়। প্রকল্পের মুখ্য সুবিধাগুলি হল:
- ঋণের পরিমাণ: সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত
- সরকারি ভর্তুকি: প্রকল্পের খরচের ১০% বা সর্বোচ্চ ২৫,০০০ টাকা
- গ্যারান্টি কভারেজ: ১০০% (৮৫% কেন্দ্রীয় সরকার + ১৫% রাজ্য সরকার)
- আমানতমুক্ত ঋণ: কোনো জামিন বা সিকিউরিটি ডিপোজিট প্রয়োজন নেই
- কর্মসংস্থানের সুযোগ: প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা
এছাড়াও, এই প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা টার্ম লোন, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন বা কম্পোজিট লোনের সুবিধা পেতে পারেন। অনুমান করা হয় যে প্রতি বছর ২ লক্ষেরও বেশি তরুণ এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন।
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের বিবরণবিষয়বিবরণপ্রকল্পের নামভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিমশুরুর তারিখ১লা এপ্রিল, ২০২৩প্রকল্পের বাজেট৩৫০ কোটি টাকাদায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগMSME&T ডিপার্টমেন্টসুবিধাভোগী১৮-৫৫ বছর বয়সী উদ্যোক্তালোনের পরিমাণসর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকাসরকারী ওয়েবসাইটbccs.wb.gov.in
যোগ্যতার মানদণ্ড
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্য নিম্নলিখিত যোগ্যতা শর্তাবলী পূরণ করতে হবে:
- আবেদনকারীকে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হতে হবে এবং কমপক্ষে ১০ বছর ধরে রাজ্যে বসবাস করতে হবে।
- আবেদনকারীর বয়স ১৮ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে হতে হবে।
- প্রকল্প/ব্যবসার খরচ ৫ লক্ষ টাকার বেশি হওয়া যাবে না।
- মোটর পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রমিকরাও এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে পারেন।
- একটি পরিবার থেকে শুধুমাত্র একজন সদস্য এই সুবিধার জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন।
- কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এই প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
- বার্ষিক পারিবারিক আয়ের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
কোন খাতে ব্যবহার করা যাবে?
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের আওতায় প্রাপ্ত ঋণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলি হল:
সেবা ক্ষেত্র (সার্ভিস সেক্টর):
- বিউটি পার্লার
- সাইবার ক্যাফে
- জেরক্স ও ল্যামিনেশন সেন্টার
- মোবাইল রিপেয়ারিং শপ
- ফটোগ্রাফি স্টুডিও
উৎপাদন ক্ষেত্র (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর):
- ছোট কুটির শিল্প
- হস্তশিল্প
- গারমেন্টস ইউনিট
- ফুড প্রসেসিং
ব্যবসায়িক ক্ষেত্র (ট্রেডিং সেক্টর):
- খুচরা দোকান
- প্রসাধনী দোকান
- কম্পিউটার ও মোবাইল অ্যাকসেসরিজ
কৃষি ক্ষেত্র (ফার্ম সেক্টর):
- পোল্ট্রি ফার্ম
- দুগ্ধ উৎপাদন
- মৎস্য চাষ
- শুকর পালন
- হাঁস-মুরগি পালন
আবেদন প্রক্রিয়া
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিমের জন্য আবেদন করতে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
অনলাইন আবেদন:
- অফিসিয়াল ওয়েবসাইট bccs.wb.gov.in এ যান।
- “নতুন নিবন্ধন” অপশন নির্বাচন করুন।
- প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ফর্ম পূরণ করুন।
- নির্দেশিত ডকুমেন্ট আপলোড করুন।
- আবেদন জমা দিন এবং অ্যাপ্লিকেশন নম্বর সংরক্ষণ করুন।
অফলাইন আবেদন:
- নিকটস্থ DIC (জেলা শিল্প কেন্দ্র) অফিস বা ব্লক অফিসে যোগাযোগ করুন।
- আবেদন ফর্ম সংগ্রহ করুন ও পূরণ করুন।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ আবেদন জমা দিন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
- আধার কার্ড
- পান কার্ড
- বাসস্থানের প্রমাণপত্র (ভোটার আইডি/রেশন কার্ড)
- বয়সের প্রমাণপত্র
- শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র
- ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিবরণী
- প্রকল্প রিপোর্ট (DPR)
- পাসপোর্ট সাইজ ফটো
প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা (২০২৫ সালের আপডেট)
২০২৫ সালের শুরুতে ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য অনুসারে:
- এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
- দেড় লক্ষেরও বেশি যুবক-যুবতী এই প্রকল্পে আবেদন করেছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৪০,০০০ জন আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।
- অনুমান করা হচ্ছে যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই মোট ঋণের পরিমাণ ১,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
- রাজ্যের প্রতিটি ব্লকে ‘শিল্পের সমাধানে’ নামক শিবির আয়োজন করা হচ্ছে, যেখানে এই প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার আগামী দিনগুলিতে এই প্রকল্পের কার্যকারিতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে এই প্রকল্পের আওতায় আসেন সেই চেষ্টাও করা হচ্ছে। রাজ্যের অর্থনৈতিক বিকাশে একদিন মাইলফলক হিসেবে প্রমাণিত হবে এই প্রকল্প।
সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের স্ট্যাটাস কিভাবে চেক করব?
আবেদন জমা দেওয়ার পর অফিসিয়াল পোর্টাল bccs.wb.gov.in তে নিবন্ধিত মোবাইল নম্বর এবং পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে লগ-ইন করে আবেদনের স্টেটাস দেখতে পারবেন। আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে কারণও উল্লেখ করা থাকবে।
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের DPR কী?
DPR হল ‘ডিটেইল্ড প্রজেক্ট রিপোর্ট’, যা আবেদনের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি। এতে আপনার ব্যবসার বিবরণ, বাজার সম্ভাবনা, প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ, ব্যবসার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে কিছু নমুনা DPR দেওয়া আছে যা আপনার প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরিতে সাহায্য করবে।
এই প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর কী?
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর হল ০৩৩-২২৬২২০০৪। হেল্পডেস্ক ইমেল: helpdesknic.bccs@gmail.com
আমি কি এই ক্রেডিট কার্ড ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারি?
না, ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে। এটি ব্যক্তিগত প্রয়োজন যেমন শিক্ষা, বিবাহ বা অন্যান্য ব্যক্তিগত খরচ মেটাতে ব্যবহার করা যাবে না।
কী কারণে আবেদন প্রত্যাখ্যান হতে পারে?
আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ:
- অসম্পূর্ণ তথ্য বা ভুল তথ্য প্রদান
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব
- যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করা
- DPR সঠিকভাবে তৈরি না করা
- একই পরিবারের একাধিক সদস্য আবেদন করা
ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিমের প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম রাজ্যে ব্যাপক সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এই প্রভাবগুলি হল:
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা বেকারত্বের হার কমাতে সাহায্য করছে।
- উদ্যোক্তা উন্নয়ন: তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নতুন ব্যবসায়িক ধারণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করছে।
- অর্থনৈতিক বৃদ্ধি: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ঘটছে, যা রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতি শক্তিশালী করছে।
- আঞ্চলিক উন্নয়ন: গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে শিল্পোদ্যোগের বিকাশ ঘটছে, যা আঞ্চলিক অসমতা কমাতে সাহায্য করছে।
পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম যুবসমাজকে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হওয়ার এক অনন্য সুযোগ প্রদান করছে। আমানতমুক্ত ঋণ ও সরকারি ভর্তুকির মাধ্যমে এই প্রকল্প রাজ্যের বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৫ সালে এই প্রকল্প আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী হবে বলে আশা করা যায়। যুবকেরা যদি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উদ্যোগী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তবে তা শুধু তাদের ব্যক্তিগত উন্নতিই নয়, সামগ্রিক রাজ্য তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়ক হবে। ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড স্কিম পশ্চিমবঙ্গের যুবশক্তিকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে পশ্চিমবঙ্গে একটি নতুন শিল্পায়নের যুগের সূচনা করতে পারে।