জিনসেং এর কাজ কি? উপকারিতা, প্রকারভেদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া | বিস্তারিত আলোচনা

জিনসেং (Ginseng) হলো একটি ঔষধি গাছ যার মূল হাজার হাজার বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্য দেশীয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞানও এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করা,…

Srijita Chattopadhay

 

জিনসেং (Ginseng) হলো একটি ঔষধি গাছ যার মূল হাজার হাজার বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী প্রাচ্য দেশীয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞানও এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করা, শক্তি বাড়ানো এবং ক্লান্তি দূর করার মতো একাধিক গুণাবলীকে সমর্থন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঐতিহ্যবাহী ঔষধের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জিনসেং-এর মতো ভেষজ উপাদানের ওপর গবেষণা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। এর মূল সক্রিয় উপাদান, জিনসেনোসাইড (ginsenosides), এর ঔষধি গুণের জন্য দায়ী এবং এটি একটি শক্তিশালী অ্যাডাপটোজেন হিসেবে কাজ করে, যা শরীরকে মানসিক ও শারীরিক চাপের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।

জিনসেং কী? (What is Ginseng?)

জিনসেং হলো Panax গণের একটি ধীর গতিতে বেড়ে ওঠা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর মাংসল মূলটি বহু শতাব্দী ধরে এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় ভেষজ প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। “জিনসেং” নামটি চীনা শব্দ “rénshēn” (人參) থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ “মানুষের মূল”। এর কারণ হলো, এই গাছের মূলের আকৃতি প্রায়শই মানুষের মতো দেখতে হয়।

জিনসেং-এর ঔষধি গুণাবলীর মূল উৎস হলো এর সক্রিয় রাসায়নিক যৌগ, যা জিনসেনোসাইড এবং জিঙ্কোনিন নামে পরিচিত। এই যৌগগুলি শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমে কাজ করে এবং এর স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে। জিনসেং একটি অ্যাডাপটোজেন হিসেবে পরিচিত। অ্যাডাপটোজেন হলো এমন প্রাকৃতিক পদার্থ যা শরীরকে শারীরিক, রাসায়নিক বা জৈবিক—যেকোনো ধরনের চাপের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। এর মানে হলো, জিনসেং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং সার্বিক সুস্থতা বাড়াতে সহায়ক।

বিভিন্ন দেশে এর চাষ হলেও, কোরিয়ান বা এশিয়ান জিনসেং (Panax ginseng) এবং আমেরিকান জিনসেং (Panax quinquefolius) সবচেয়ে পরিচিত এবং গবেষণালব্ধ প্রজাতি। এদের মধ্যে জিনসেনোসাইডের পরিমাণ এবং প্রকারের ভিন্নতা থাকায় তাদের কার্যকারিতাতেও কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ান জিনসেং সাধারণত উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে আমেরিকান জিনসেং শরীরকে শান্ত করতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।

জিনসেং-এর প্রকারভেদ (Types of Ginseng)

বিশ্বে বিভিন্ন ধরণের জিনসেং পাওয়া যায়, তবে কার্যকারিতা এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে কয়েকটি প্রজাতি প্রধান। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো জিনসেনোসাইড নামক সক্রিয় যৌগের ঘনত্ব এবং প্রকার।

এশিয়ান জিনসেং (Asian Ginseng – Panax ginseng)

এটি কোরিয়ান জিনসেং নামেও পরিচিত এবং সবচেয়ে বেশি গবেষণাকৃত প্রজাতি। এটি সাধারণত শক্তি বৃদ্ধি, ক্লান্তি দূরীকরণ এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। একে প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:

  • সাদা জিনসেং (White Ginseng): এটি তাজা জিনসেং মূলকে শুকিয়ে তৈরি করা হয়।
  • লাল জিনসেং (Red Ginseng): এই ক্ষেত্রে, মূলকে শুকানোর আগে বাষ্পে সেদ্ধ করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে এতে জিনসেনোসাইডের রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন আসে এবং এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI) এর একটি গবেষণা অনুসারে, লাল জিনসেং-এ অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী বেশি থাকে।

আমেরিকান জিনসেং (American Ginseng – Panax quinquefolius)

এই প্রজাতির জিনসেং মূলত উত্তর আমেরিকার অ্যাপালাচিয়ান এবং ওজার্ক অঞ্চলে জন্মায়। ঐতিহ্যগতভাবে, এটি শরীরকে শান্ত করতে, চাপ কমাতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। এশিয়ান জিনসেং-এর তুলনায় এর প্রভাব কিছুটা মৃদু এবং এটি উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে না। আমেরিকান জিনসেং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে বলে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে।

সাইবেরিয়ান জিনসেং (Siberian Ginseng – Eleutherococcus senticosus)

নামে “জিনসেং” থাকলেও, এটি আসলে Panax গণের অন্তর্গত নয় এবং এতে জিনসেনোসাইড থাকে না। এর সক্রিয় উপাদান হলো এলিউথেরোসাইড (eleutherosides)। তবে এর কার্যকারিতা জিনসেং-এর মতোই, বিশেষ করে শক্তি বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। তাই এটিও একটি শক্তিশালী অ্যাডাপটোজেন হিসেবে পরিচিত।

বৈশিষ্ট্য এশিয়ান জিনসেং (Panax ginseng) আমেরিকান জিনসেং (Panax quinquefolius) সাইবেরিয়ান জিনসেং (Eleutherococcus senticosus)
উৎপত্তিস্থল কোরিয়া, চীন, সাইবেরিয়া উত্তর আমেরিকা রাশিয়া, উত্তর-পূর্ব এশিয়া
সক্রিয় উপাদান জিনসেনোসাইড জিনসেনোসাইড এলিউথেরোসাইড
প্রধান কাজ উদ্দীপক, শক্তি বর্ধক, মানসিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি শান্তকারক, চাপ হ্রাস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি শক্তি বৃদ্ধি, শারীরিক সহনশীলতা বৃদ্ধি, ক্লান্তি দূরীকরণ
প্রভাব উষ্ণ এবং উদ্দীপক শীতল এবং শান্তকারক নিরপেক্ষ এবং অ্যাডাপটোজেনিক

জিনসেং-এর প্রধান কাজ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা

আধুনিক বিজ্ঞান জিনসেং-এর ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারকে সমর্থন করে এবং এর বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। নিচে এর প্রধান কার্যকারিতাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে (Enhances Brain Function)

জিনসেং স্মৃতিশক্তি, আচরণ এবং মেজাজ উন্নত করতে সহায়ক। এর মধ্যে থাকা জিনসেনোসাইড এবং যৌগ (Compound K) মস্তিষ্কের কোষকে ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।

  • স্মৃতিশক্তি ও শেখার ক্ষমতা: Journal of Ginseng Research-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত Panax ginseng গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক কর্মক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়।
  • আলঝেইমার রোগ: কিছু প্রাথমিক গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে জিনসেং আলঝেইমার রোগীদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১২ সপ্তাহ ধরে জিনসেং গ্রহণকারী আলঝেইমার রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে এই বিষয়ে আরও বড় আকারের গবেষণা প্রয়োজন।
  • মানসিক ক্লান্তি: জিনসেং মানসিক চাপ এবং ক্লান্তি কমাতেও সাহায্য করে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক পরিশ্রম করেন, তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে (Boosts the Immune System)

জিনসেং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ম্যাক্রোফেজ, ন্যাচারাল কিলার সেল এবং টি-সেলের মতো প্রতিরোধক কোষের সংখ্যা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত জিনসেং সেবন করেন, তাদের সাধারণ সর্দি-কাশি এবং ফ্লু হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। Cochrane Library-এর একটি পর্যালোচনা অনুসারে, জিনসেং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ (respiratory tract infections) প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। কোলন ক্যান্সারের রোগীদের উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কেমোথেরাপির পাশাপাশি জিনসেং গ্রহণ করলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে।

৩. শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ক্লান্তি দূর করে (Increases Energy and Fights Fatigue)

জিনসেং শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর করার জন্য একটি জনপ্রিয় প্রাকৃতিক প্রতিকার। এটি শরীরের কোষগুলিতে শক্তি উৎপাদন বাড়াতে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।

  • ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম: দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তিতে ভোগা রোগীদের জন্য জিনসেং উপকারী হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, Panax ginseng গ্রহণকারী ব্যক্তিরা প্লাসিবো গ্রহণকারীদের তুলনায় শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি অনুভব করেছেন।
  • ক্যান্সারজনিত ক্লান্তি: ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ক্লান্তি একটি সাধারণ সমস্যা। Mayo Clinic-এর গবেষকদের মতে, আমেরিকান জিনসেং ক্যান্সার রোগীদের ক্লান্তি কমাতে একটি কার্যকর এবং নিরাপদ বিকল্প হতে পারে।

৪. অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী (Anti-inflammatory and Antioxidant Properties)

জিনসেং-এর জিনসেনোসাইডগুলিতে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি শরীরের প্রদাহ কমাতে এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের কারণে কোষের ক্ষতি রোধ করতে সাহায্য করে।

  • প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ: জিনসেনোসাইডগুলি শরীরের প্রদাহ সৃষ্টিকারী পথগুলিকে (inflammatory pathways) নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়।
  • কোষের সুরক্ষা: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে জিনসেং ফ্রি র‍্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যা অকাল বার্ধক্য এবং বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। একজিমা বা অন্যান্য প্রদাহজনিত ত্বকের সমস্যায় জিনসেং ক্রিম ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।

৫. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে (Helps Regulate Blood Sugar Levels)

আমেরিকান এবং এশিয়ান উভয় প্রকার জিনসেং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। এটি অগ্ন্যাশয়ের কোষের কার্যকারিতা উন্নত করতে, ইনসুলিন উৎপাদন বাড়াতে এবং রক্তে শর্করার শোষণ উন্নত করতে সাহায্য করে।

আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (American Diabetes Association)-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমেরিকান জিনসেং টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিসের ওষুধ গ্রহণকারী রোগীদের জিনসেং ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ এটি হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া) ঘটাতে পারে।

৬. ইরেক্টাইল ডিসফাংশন উন্নত করতে পারে (May Improve Erectile Dysfunction)

জিনসেং পুরুষদের ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (ED) এর চিকিৎসায় একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। এর কারণ হলো, জিনসেং-এর যৌগগুলি রক্তনালীর অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে এবং নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। নাইট্রিক অক্সাইড পুরুষাঙ্গের পেশী শিথিল করে এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, যা ইরেকশন উন্নত করে।

কোরিয়ান রেড জিনসেং নিয়ে করা একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি ED-এর লক্ষণগুলি উন্নত করতে প্লাসিবোর চেয়ে প্রায় ৬০% বেশি কার্যকর। British Journal of Clinical Pharmacology-তে প্রকাশিত একটি মেটা-অ্যানালিসিস এই দাবিকে সমর্থন করে।

৭. ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সুরক্ষা (Potential Protection Against Cancer)

জিনসেং-এর জিনসেনোসাইডগুলি টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করতে এবং ক্যান্সার কোষের অ্যাপোপটোসিস (প্রোগ্রামড সেল ডেথ) ঘটাতে সাহায্য করতে পারে। যদিও জিনসেং ক্যান্সারের নিরাময় নয়, তবে কিছু গবেষণা অনুযায়ী এটি নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

  • কোলন ক্যান্সার: একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত জিনসেং গ্রহণ করেন, তাদের কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কম।
  • কেমোথেরাপির কার্যকারিতা: জিনসেং কেমোথেরাপির কার্যকারিতা বাড়াতে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন বমি বমি ভাব, ক্লান্তি এবং ক্ষুধামান্দ্য, কমাতে সাহায্য করতে পারে। ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (National Cancer Institute) উল্লেখ করেছে যে, জিনসেং-এর মতো ভেষজ সম্পূরকগুলি ব্যবহারের আগে ক্যান্সার রোগীদের অনকোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি।

ব্যবহারের নিয়ম এবং সতর্কতা (Dosage and Precautions)

জিনসেং বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়, যেমন – কাঁচা মূল, শুকনো গুঁড়ো, ক্যাপসুল, ট্যাবলেট, এবং তরল নির্যাস। এর ডোজ নির্ভর করে কী কারণে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং জিনসেং-এর প্রকারের উপর।

সাধারণ ডোজ:

  • শুকনো মূল: প্রতিদিন ১-২ গ্রাম।
  • নির্যাস (Extract): প্রতিদিন ২০০-৪০০ মিলিগ্রাম (স্ট্যান্ডার্ডাইজড জিনসেনোসাইড ৪-৫%)।

তবে যেকোনো সম্পূরক শুরু করার আগে একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।

সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সতর্কতা

জিনসেং সাধারণত স্বল্পমেয়াদী ব্যবহারের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, যেমন:

  • মাথাব্যথা
  • ঘুমের সমস্যা (অনিদ্রা)
  • হজমের সমস্যা
  • রক্তচাপের পরিবর্তন
  • স্নায়বিক দুর্বলতা বা অতিরিক্ত উত্তেজনা (বিশেষ করে এশিয়ান জিনসেং-এর ক্ষেত্রে)

যাদের জিনসেং ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিত:

  • গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী: পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে তাদের জিনসেং এড়িয়ে চলা উচিত।
  • শিশু: শিশুদের জন্য জিনসেং সুপারিশ করা হয় না।
  • অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা লুপাসের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জিনসেং এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এটি ইমিউন সিস্টেমকে আরও সক্রিয় করতে পারে।
  • রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা: যারা রক্ত পাতলা করার ওষুধ (যেমন ওয়ারফারিন) গ্রহণ করেন, তাদের জিনসেং ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এটি রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • ডায়াবেটিস রোগী: রক্তে শর্করার মাত্রা নিরীক্ষণ করা প্রয়োজন, কারণ জিনসেং ওষুধের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে।
  • উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জিনসেং গ্রহণ করা উচিত নয়।

জিনসেং একটি শক্তিশালী ভেষজ যা হাজার হাজার বছর ধরে তার ঔষধি গুণের জন্য সমাদৃত হয়ে আসছে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং ক্লান্তি দূর করা পর্যন্ত এর উপকারিতা ব্যাপক। আধুনিক বিজ্ঞানও এর অনেক ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারকে সমর্থন করে।

তবে, এর কার্যকারিতা সত্ত্বেও, জিনসেং কোনো জাদুকরী সমাধান নয়। এটি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। যেকোনো ভেষজ সম্পূরকের মতো, জিনসেং ব্যবহারের আগে এর সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি। আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর ভিত্তি করে এটি আপনার জন্য উপযুক্ত কিনা, তা জানতে সর্বদা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সঠিক ব্যবহারে, জিনসেং আপনার সার্বিক সুস্থতা বাড়াতে একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক উপাদান হতে পারে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।