আমাদের শরীর একটি জটিল যন্ত্রের মতো, যার প্রতিটি অংশ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই জটিল ব্যবস্থায় স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেম হলো মাস্টার কন্ট্রোলার, যা মস্তিষ্ক থেকে শরীরের প্রতিটি কোণায় সংকেত পৌঁছে দেয়। কিন্তু যখন এই স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এখানেই নিউরোবেস্ট (Neurobest) -এর মতো সাপ্লিমেন্টের ভূমিকা সামনে আসে। নিউরোবেস্ট মূলত একটি মাল্টিভিটামিন এবং মিনারেল সাপ্লিমেন্ট, যা বিশেষভাবে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং বিভিন্ন নিউরোপ্যাথিক সমস্যা (স্নায়ুজনিত ব্যথা) মোকাবিলার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আলফা লিপোইক অ্যাসিড এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের এক শক্তিশালী সংমিশ্রণ, যা ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু পুনর্গঠনে এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা স্নায়ুজনিত সমস্যায় ভোগেন, যার অন্যতম প্রধান কারণ ডায়াবেটিস এবং ভিটামিনের অভাব। নিউরোবেস্ট এই ধরনের সমস্যা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
নিউরোবেস্ট কী এবং কেন এটি প্রয়োজন?
নিউরোবেস্ট কোনো সাধারণ ভিটামিন ট্যাবলেট নয়। এটি একটি বিশেষভাবে ফর্মুলেটেড নিউরোট্রপিক সাপ্লিমেন্ট, যার প্রধান কাজ হলো স্নায়ুতন্ত্রকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করা। আমাদের স্নায়ু কোষ বা নিউরনগুলোর সঠিক কার্যকারিতার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টির প্রয়োজন হয়। যখন খাদ্যাভ্যাসের কারণে বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যার জন্য শরীর এই পুষ্টিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় না, তখন স্নায়ুগুলো দুর্বল হতে শুরু করে। এর ফলে হাতে-পায়ে ঝিঁঝি ধরা, অবশ ভাব, জ্বালাপোড়া বা তীব্র ব্যথার মতো অনুভূতি হতে পারে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় নিউরোপ্যাথি বলা হয়।
বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি খুব সাধারণ, যা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি নামে পরিচিত। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (ADA)-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৫০% ডায়াবেটিস রোগী কোনো না কোনো ধরনের নিউরোপ্যাথিতে আক্রান্ত হন। নিউরোবেস্টের মধ্যে থাকা সক্রিয় উপাদানগুলি এই ধরনের স্নায়ুজনিত ক্ষতি মেরামত করতে এবং ব্যথা কমাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
নিউরোবেস্টের প্রধান উপাদান এবং তাদের কার্যকারিতা
নিউরোবেস্টের কার্যকারিতা বোঝার জন্য এর উপাদানগুলির ভূমিকা জানা অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি উপাদান স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষায় নির্দিষ্ট কাজ করে থাকে।
মিথাইলকোবালামিন (ভিটামিন বি১২)
এটি ভিটামিন বি১২-এর একটি সক্রিয় রূপ, যা শরীর সরাসরি শোষণ করতে পারে। এর প্রধান কাজ হলো:
- মায়েলিন শিথ তৈরি: স্নায়ু কোষের চারপাশে থাকা মায়েলিন নামক সুরক্ষামূলক আবরণ তৈরি এবং পুনর্গঠনে মিথাইলকোবালামিন অপরিহার্য। এই আবরণটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্নায়ুর সংকেত পরিবহনে বাধা সৃষ্টি হয়।
- স্নায়ু পুনর্জন্ম: এটি ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু কোষকে পুনরায় সজীব করতে এবং নতুন স্নায়ু তৈরিতে উৎসাহিত করে।
- হোমোসিস্টাইন কমানো: রক্তে হোমোসিস্টাইনের মাত্রা বেড়ে গেলে তা স্নায়ু এবং রক্তনালীর ক্ষতি করে। মিথাইলকোবালামিন হোমোসিস্টাইনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভিটামিন বি১২-এর অভাব স্নায়বিক এবং মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।
আলফা লিপোইক অ্যাসিড (ALA)
এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীর নিজে থেকেই অল্প পরিমাণে তৈরি করতে পারে। এর কাজগুলো হলো:
- অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমানো: ডায়াবেটিসের মতো রোগে শরীরে ফ্রি র্যাডিক্যালের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা স্নায়ু কোষের ব্যাপক ক্ষতি করে। ALA এই ফ্রি র্যাডিক্যালগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে স্নায়ুকে রক্ষা করে।
- রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি: এটি স্নায়ুতে রক্ত সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, ফলে স্নায়ু কোষগুলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টি পায়।
- ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি: ALA কোষের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বেনফোটিয়ামিন (ভিটামিন বি১)
এটি ভিটামিন বি১ বা থিয়ামিনের একটি ফ্যাট-সলিউবল রূপ, যা সাধারণ থিয়ামিনের চেয়ে অনেক সহজে এবং বেশি পরিমাণে শোষিত হয়।
- ডায়াবেটিক জটিলতা প্রতিরোধ: উচ্চ রক্ত শর্করা থেকে তৈরি হওয়া ক্ষতিকারক পদার্থ (Advanced Glycation End products – AGEs) কমাতে বেনফোটিয়ামিন বিশেষভাবে কার্যকর। এই AGEs স্নায়ু এবং রক্তনালীর ক্ষতির জন্য দায়ী।
- শক্তি উৎপাদন: এটি কার্বোহাইড্রেটকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে, যা স্নায়ু কোষের সঠিক কার্যকারিতার জন্য জরুরি।
পাইরিডক্সিন (ভিটামিন বি৬)
ভিটামিন বি৬ স্নায়ুতন্ত্রের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান।
- নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি: এটি সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং গাবা (GABA)-র মতো গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার তৈরিতে সাহায্য করে, যা মেজাজ, ঘুম এবং ব্যথা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
- স্নায়ুর সংকেত পরিবহন: সঠিক স্নায়বিক সংকেত পরিবহনের জন্য পাইরিডক্সিন প্রয়োজন।
ফলিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৯)
ফলিক অ্যাসিড বা ভিটামিন বি৯ স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে এবং ডিএনএ (DNA) সংশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- স্নায়ু কোষের বৃদ্ধি: এটি নতুন কোষ তৈরি এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামতে সাহায্য করে।
- জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ: গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ শিশুর মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটি (নিউরাল টিউব ডিফেক্ট) প্রতিরোধ করে, যা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) দ্বারা প্রমাণিত।
অন্যান্য উপাদান
কিছু নিউরোবেস্ট ফর্মুলেশনে ইনোসিটল এবং ভিটামিন ডি৩-এর মতো উপাদানও থাকে। ইনোসিটল স্নায়ুর সংকেত পরিবহনে সাহায্য করে এবং ভিটামিন ডি৩ স্নায়ুর প্রদাহ কমাতে ও সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভূমিকা রাখে।
নিউরোবেস্ট কাদের জন্য প্রয়োজনীয়?
নিউরোবেস্ট মূলত নিম্নলিখিত সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে চিকিৎসক দ্বারা সুপারিশ করা হয়ে থাকে:
- ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি: ডায়াবেটিস রোগীদের হাত-পায়ে জ্বালাপোড়া, ঝিঁঝি ধরা, বা অবশ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় এটি অত্যন্ত কার্যকর।
- পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি: বিভিন্ন কারণে (যেমন – আঘাত, সংক্রমণ বা অজানা কারণ) হওয়া স্নায়ুজনিত সমস্যায় এটি ব্যবহৃত হয়।
- সায়াটিকা: সায়াটিক নার্ভের ব্যথা কমাতেও এটি সহায়ক হতে পারে।
- ভিটামিনের অভাব: শরীরে বিশেষ করে ভিটামিন বি১, বি৬ এবং বি১২-এর অভাব পূরণের জন্য এটি দেওয়া হয়।
- অ্যালকোহলিক নিউরোপ্যাথি: অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার চিকিৎসায় এটি একটি সহায়ক সাপ্লিমেন্ট হিসেবে কাজ করে।
- সাধারণ দুর্বলতা এবং ক্লান্তি: স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে সৃষ্ট ক্লান্তি দূর করতেও এটি সাহায্য করে।
কার্যকারিতা ক্ষেত্র | নিউরোবেস্টের ভূমিকা | প্রধান উপাদান |
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি | স্নায়ুর ক্ষতি মেরামত ও ব্যথা কমানো | আলফা লিপোইক অ্যাসিড, বেনফোটিয়ামিন, মিথাইলকোবালামিন |
স্নায়ু পুনর্গঠন | মায়েলিন শিথ তৈরি ও স্নায়ু পুনর্জন্ম | মিথাইলকোবালামিন (ভিটামিন বি১২) |
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সুরক্ষা | ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে স্নায়ু রক্ষা | আলফা লিপোইক অ্যাসিড |
শক্তি উৎপাদন | স্নায়ু কোষের জন্য শক্তি সরবরাহ | বেনফোটিয়ামিন (ভিটামিন বি১) |
নিউরোট্রান্সমিটার সংশ্লেষণ | মস্তিষ্কের রাসায়নিক সংকেত নিয়ন্ত্রণ | পাইরিডক্সিন (ভিটামিন বি৬) |
পরিসংখ্যানের আলোকে নিউরোপ্যাথি এবং ভিটামিনের গুরুত্ব
নিউরোপ্যাথি একটি ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (IDF)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে প্রায় ৫৩৭ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৭৮৩ মিলিয়নে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির প্রকোপ।
অন্যদিকে, ভিটামিন বি১২-এর অভাবও একটি গুরুতর সমস্যা। The Lancet-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, বয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন বি১২-এর অভাবের হার বেশ উচ্চ, যা স্নায়বিক জটিলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এই পরিসংখ্যানগুলো নিউরোবেস্টের মতো সাপ্লিমেন্টের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
ব্যবহারবিধি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
নিউরোবেস্ট সাধারণত দিনে একটি বা দুটি ট্যাবলেট খাবারের পরে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে, মাত্রা এবং সময়কাল রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং চিকিৎসকের পরামর্শের উপর নির্ভর করে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
যদিও নিউরোবেস্ট সাধারণত একটি নিরাপদ সাপ্লিমেন্ট, তবে কিছু ক্ষেত্রে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন:
- বমি বমি ভাব
- পেটের সমস্যা
- মাথাব্যথা
- ত্বকে ফুসকুড়ি
তবে, এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত হালকা এবং অস্থায়ী হয়। যদি কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা এবং অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে নিউরোবেস্ট গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, নিউরোবেস্ট একটি আধুনিক এবং কার্যকরী নিউরোট্রপিক সাপ্লিমেন্ট যা স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা, বিশেষ করে নিউরোপ্যাথিক ব্যথা এবং ভিটামিনের অভাব পূরণে একটি নির্ভরযোগ্য সমাধান। এর মধ্যে থাকা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উপাদানগুলি ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে মনে রাখা জরুরি যে, নিউরোবেস্ট কোনো রোগ নিরাময়ের জাদুকরী ঔষধ নয়, এটি একটি সহায়ক চিকিৎসা। সুস্থ জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানই স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখার মূল চাবিকাঠি। যেকোনো সাপ্লিমেন্ট শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা সর্বদা বুদ্ধিমানের কাজ।