চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী – এই নামটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে একটি পরিচিত নাম। কিন্তু সম্প্রতি তিনি হঠাৎ করেই সংবাদ শিরোনামে এসেছেন, তাও অপ্রত্যাশিত কারণে। গত ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই ঘটনা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই বিতর্কিত গ্রেফতারের পিছনের কাহিনী।
কে এই চিন্ময় কৃষ্ণ দাস?
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী হিন্দু ধর্মীয় নেতা। তিনি চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধামের প্রধান এবং বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতন জাগরণ জোটের একজন সদস্য।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আগে ইসকনের (ISKCON) সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেখানে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হিন্দুদের উপর বাড়ছে হামলা, উদ্বেগ প্রকাশ ছাত্রছাত্রীদের
গ্রেফতারের কারণ
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পিছনে মূল কারণ হিসেবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর আগে ২৫ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে চট্টগ্রামে একটি বৃহৎ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। এই সমাবেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া হামলার প্রতিবাদ জানানো হয় এবং সরকারের কাছে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবি জানানো হয়।
কিন্তু এই সমাবেশ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অভিযোগ ওঠে যে, সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এই ঘটনার জেরে ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়।
গ্রেফতারের প্রতিক্রিয়া
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় মোড়ে শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রাস্তায় নেমে তার মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া রাজধানী ঢাকার শাহবাগ মোড়েও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।
ইসকন (ISKCON) এই গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা ভারত সরকারের কাছে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। ইসকনের বক্তব্য, “আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ভক্তি আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই”।
বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক গুরু সদগুরু এই গ্রেফতারকে “লজ্জাজনক” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “একটি গণতান্ত্রিক দেশ কীভাবে ধর্মতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে তা দেখে লজ্জা লাগে”।
আইনি প্রক্রিয়া
২৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে বিচারিক হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পুলিশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের রিমান্ড আবেদন না করায় আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তবে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন যে, কারাগারে তার সব ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে হিন্দু এসআইদের ‘ঢালাও’ বাদ, হিন্দুদের জন্য কতটা নিরাপদ স্বাধীন
বিতর্কের পটভূমি
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারের পিছনে রয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দেশটিতে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার ভূমিকা পালন করছিলেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক সংগঠন এই গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন”।
সামগ্রিক প্রভাব
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা দেশটির গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮% হিন্দু। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের উপর হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো একজন প্রভাবশালী নেতার গ্রেফতার সংখ্যালঘুদের মধ্যে আরও ভীতি সঞ্চার করেছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির একটি জটিল চিত্র তুলে ধরেছে। এই ঘটনা দেশটির গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আগামী দিনগুলোতে এই বিষয়টি কীভাবে মোকাবেলা করা হয় তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দল উভয়কেই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করার পাশাপাশি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও জরুরি। আশা করা যায়, সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে বাংলাদেশ।