Electrolyte imbalance symptoms : আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে যে জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে, সেখানে ইলেক্ট্রোলাইটের ভূমিকা অপরিহার্য। এই খনিজ পদার্থগুলো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে কি হয় – এই প্রশ্নের উত্তর জানা প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরি। কারণ ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি শুধুমাত্র সাধারণ দুর্বলতা নয়, বরং মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। আজকের এই আলোচনায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব ইলেক্ট্রোলাইটের অভাব আমাদের শরীরে কী ধরনের প্রভাব ফেলে এবং কীভাবে এই সমস্যা থেকে বাঁচা যায়।
ইলেক্ট্রোলাইট কী এবং কেন প্রয়োজনীয়
ইলেক্ট্রোলাইট হলো এমন খনিজ পদার্থ যা পানিতে দ্রবীভূত হলে বৈদ্যুতিক চার্জ বহন করে। আমাদের শরীরের প্রধান ইলেক্ট্রোলাইটগুলো হলো সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্লোরাইড এবং ফসফরাস। এই পদার্থগুলো আমাদের রক্ত, ঘাম এবং প্রস্রাবে পাওয়া যায়।
শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের কাজ অসংখ্য। এগুলো আমাদের শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পুনর্নির্মাণে সাহায্য করে এবং রক্তের অম্লতা ও চাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। পেশী, হৃৎপিণ্ড এবং স্নায়ু কোষগুলি ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার করে অন্য কোষে বৈদ্যুতিক আবেগ বহন করতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর জলের ভারসাম্য বজায় রাখতেও ইলেক্ট্রোলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের শরীরে পানির পরিমাণ অবশ্যই ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে।
ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে কি হয় – প্রধান লক্ষণসমূহ
যখন আমাদের শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে কি হয় তার উত্তর বেশ ভয়াবহ। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর জন্য ইলেক্ট্রোলাইট প্রয়োজন হয়, তাই এদের সংখ্যা হ্রাস পেলে অবিলম্বে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়।
ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
- মাথা ঘোরা এবং ঝিমুনি – এটি প্রায় সব ধরনের ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে দেখা যায়
- মানসিক বিভ্রান্তি – চিন্তাভাবনায় অস্পষ্টতা এবং মনোযোগ দিতে অসুবিধা
- অনিয়মিত হৃদস্পন্দন – এটি জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে
- পেশীতে দুর্বলতা এবং খিঁচুনি – সাধারণ নড়াচড়ায়ও অসুবিধা
- শারীরিক দুর্বলতা – পর্যাপ্ত ঘুম ও খাবারের পরেও ক্লান্তি
- মাথাব্যথা এবং বমি বমি ভাব
- রক্তচাপে পরিবর্তন – উচ্চ বা নিম্ন দুটোই হতে পারে
সোডিয়াম কমে গেলে যা ঘটে
সোডিয়ামের অভাব বা হাইপোনেট্রিমিয়া হলে শরীরে তরলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। মাইল্ড হাইপোনেট্রিমিয়া হলে হজমশক্তির সমস্যা, মাথা ধরা, বমি বমি ভাব এবং কোনো কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে যায়।
মডারেট হাইপোনেট্রিমিয়ায় ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে পেশিতে টান, পেশির অসাড়তা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে। তীব্র হাইপোনেট্রিমিয়ার ক্ষেত্রে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, চেতনা কমে যাওয়া এবং উল্টোপাল্টা আচরণের মতো উপসর্গ দেখা যায়।
পটাশিয়ামের অভাবে সৃষ্ট সমস্যা
পটাশিয়ামের অভাব বা হাইপোক্যালিমিয়ায় হজমে সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পর্যাপ্ত ঘুম ও খাওয়ার পরেও ক্লান্তি অনুভূত হলে পটাশিয়ামের ঘাটতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পটাশিয়ামের মাত্রা কম থাকলে শরীরে ইনসুলিন কম উৎপাদিত হয় এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে। এতে মাংসপেশির দুর্বলতা এবং মাংসপেশিতে ঘন ঘন টান লাগার মতো সমস্যাও তৈরি হয়। যদি রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা ২.৫ মিলিমোলের নিচে চলে যায় এবং ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হয়, জীবনহানিও হতে পারে।
অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইটের ঘাটতি
ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলেও গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে ৮০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি বেশি হয়।
হাইপোনেট্রিমিয়া এবং হাইপোক্যালসিমিয়া দৈনন্দিন কাজকর্মে স্বাধীনতার সাথে যুক্ত। যাদের একাধিক ইলেক্ট্রোলাইট অস্বাভাবিকতা রয়েছে তাদের কার্যকর নির্ভরতার ঝুঁকি বেশি।
ইলেক্ট্রোলাইট হ্রাসের কারণসমূহ
শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রধান কারণগুলো হলো:
অতিরিক্ত ঘাম – গরমে বা ব্যায়ামের সময় প্রচুর ঘাম হলে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম বেরিয়ে যায়। ডায়রিয়া বা অত্যধিক বমি হলে রক্তে সোডিয়াম এবং পটাশিয়ামের মাত্রা কমতে পারে।
কিডনির সমস্যা – কিডনি কাজকর্মে বিকৃতি হলে তার থেকে শরীরে থাকা ইলেক্ট্রোলাইটগুলি অস্বাভাবিক মাত্রায় বেরিয়ে যায় অথবা জমা হয়। ডায়াবিটিস বা কিডনির অসুখ থেকে বেশি বা কম মাত্রায় মূত্র হলে ইলেক্ট্রোলাইটসের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – অনেক সময়ে বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ বা প্রেশারের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মিনারেলের ভারসাম্য নষ্টের কারণ হয়। থায়াজাইড ডাইইউরেটিক, লুপ ডাইইউরেটিক এবং পটাশিয়াম-স্পেয়ারিং ডাইইউরেটিক বিভিন্ন ইলেক্ট্রোলাইট ব্যাধির সাথে স্বতন্ত্রভাবে যুক্ত।
খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণ – অত্যধিক ডায়েট কন্ট্রোল করলেও কিন্তু সোডিয়াম, পটাশিয়াম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্যে লবণের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বা কম হলেও ইলেক্ট্রোলাইটসের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
মারাত্মক জটিলতা ও বিপদসমূহ
ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে কি হয় এর সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো এর জীবনঘাতী জটিলতা। গবেষণায় দেখা গেছে যে ইলেক্ট্রোলাইট অস্বাভাবিকতা রোগীদের মৃত্যুর হার ২৭.৯%, যা স্বাভাবিক ইলেক্ট্রোলাইট রোগীদের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি।
হৃদযন্ত্রের সমস্যা সবচেয়ে বিপজ্জনক। পটাশিয়ামের মাত্রা খুব কম হলে হার্টের অস্বাভাবিক ছন্দ ঘটতে পারে। আবার অত্যন্ত উচ্চ পটাশিয়ামের মাত্রাও ঝুঁকিপূর্ণ, যা হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দিতে পারে।
স্নায়বিক জটিলতা অত্যন্ত গুরুতর। ব্রেইন সেল কাজ করে না, ভুলে যাওয়ার সমস্যা, ভাবাচ্ছন্নতা, এমনকি খিঁচুনিও হয়। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হলে কোমাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।
পেশী সংক্রান্ত সমস্যা দৈনন্দিন জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। প্যারালিসিস, মাংসপেশির টিস্যু ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
করোনা মহামারীর সময় গবেষণায় দেখা গেছে যে হাইপোনেট্রিমিয়া হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধির সাথে উল্লেখযোগ্য সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা
সৌভাগ্যবশত, সঠিক পদক্ষেপ নিলে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। কলা পটাশিয়াম সমৃদ্ধ, যা তরল ভারসাম্য, স্নায়ুর কার্যকারিতা এবং পেশী সংকোচন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নারিকেলের পানি প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট সাপ্লিমেন্ট হিসেবে কাজ করে।
তরমুজ কেবল ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ নয়, জলীয় পদার্থ বেশি থাকায় শরীর আর্দ্র রাখে। গরমকালে প্রচুর পরিমাণে তরমুজ খাওয়া যেতে পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে:
- ইনজেকশন অথবা খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোলাইট সম্পূরক দেওয়া
- পটাশিয়ামের মতো ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ তাজা ফল খাওয়া
- পেশীতে খিঁচ, মাথাব্যথা, বমিভাব ইত্যাদি থেকে উপশমের জন্য উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা
- শরীর ফোলার ক্ষেত্রে পানি খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ
বিশেষ করে গরম আবহাওয়া, তীব্র ব্যায়ামের সময়, অথবা অতিরিক্ত ঘাম, পেশীতে টান, ক্লান্তি, মাথা ঘোরা, বা বমি বমি ভাবের মতো লক্ষণ দেখা দিলে, ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইলেক্ট্রোলাইট কমে গেলে কি হয় – এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলের জানা থাকা উচিত। ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা শুধুমাত্র একটি ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং এটি জীবনঘাতী হতে পারে। তবে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
নিয়মিত পানি পান করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত ঘাম হলে ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া এবং যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া – এই সহজ নিয়মগুলো মেনে চললে আমরা ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারি। মনে রাখবেন, আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের সুস্থতার জন্য ইলেক্ট্রোলাইটের সঠিক ভারসাম্য অপরিহার্য।