ছেলে ও মেয়েদের হরমোন বেশি হলে কি হয়?

Hormonal changes in boys and girls: হরমোন আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক বার্তাবাহক, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। জন্ম থেকে শুরু করে বয়ঃসন্ধি, প্রজনন থেকে বিপাক – সবকিছুতেই হরমোনের ভূমিকা অপরিসীম। তবে যখন এই হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, বিশেষত যখন কোনো হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, তখন শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে ভুগছেন, যা পুরুষ হরমোনের আধিক্যের কারণে হয়। আসুন জেনে নেই ছেলে ও মেয়েদের শরীরে হরমোন বেশি হলে কী ধরনের পরিবর্তন ও সমস্যা দেখা দেয়।

নারীদেহে পুরুষ হরমোন বেশি হলে যেসব সমস্যা দেখা দেয়

নারীদেহে এন্ড্রোজেন বা পুরুষ যৌন হরমোন স্বাভাবিকভাবেই অল্প পরিমাণে থাকে, কিন্তু যখন এর মাত্রা বেড়ে যায়, তখন নানা শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের ২০০টিরও বেশি কাজ রয়েছে, কিন্তু এর আধিক্য অনেক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS)

পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) মেয়েদের খুবই পরিচিত একটি হরমোনজনিত রোগ। প্রতি ১০ জন নারীর একজন এই সমস্যায় আক্রান্ত। এন্ড্রোজেন হরমোন বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু হরমোন, জিন ও পরিবেশগত সমস্যার মিলিত প্রভাব রয়েছে। PCOS-এর প্রধান লক্ষণগুলি হল:

• অনিয়মিত মাসিক বা টানা কয়েক মাসের জন্য মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া

• অতিরিক্ত রক্তস্রাব

• মুখে ও শরীরের অন্যান্য অংশে ব্রণ

• শরীরে অতিরিক্ত লোম গজানো (হিরসুটিজম)

• ওজন বাড়া ও আকৃতিগত পরিবর্তন

শারীরিক পরিবর্তনসমূহ

নারীদেহে অ্যান্ড্রোজেন বেশি হলে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে:

• সিবেসিয়াস গ্রন্থি বেড়ে যাওয়া, যা ব্রণের কারণ হতে পারে

• ভগাংকুর (Clitoris) বর্ধিত হওয়া

• শ্রোণীদেশের চুল নিচে উরু এবং উপরে নাভী পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া

• মুখমণ্ডলে চুল (জুল্পি, গোঁফ, দাঁড়ি) গজানো

• মাথার চুল কমে যাওয়া

• বুকে, বৃন্তের চারপাশে, নিতম্বে লোম গজানো

• পেশি বৃদ্ধি

• গাঢ় কণ্ঠস্বর হওয়া

উর্বরতা ও প্রজনন সমস্যা

অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। PCOS আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে ডিম্বস্ফোটন ব্যাহত হয়, যা গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করে। মহিলাদের শরীরে হরমোনগুলি প্রজনন ব্যবস্থায় সূক্ষ্মভাবে সুরক্ষিত এবং আন্তঃসংযুক্ত। এই হরমোনের যেকোনো একটিতে ভারসাম্যহীনতা গর্ভধারণ বা গর্ভাবস্থায় অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।

পুরুষদেহে স্ত্রী হরমোন বেশি হলে যেসব সমস্যা দেখা দেয়

পুরুষদের শরীরেও স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিমাণ ইস্ট্রোজেন (স্ত্রী হরমোন) থাকে। যখন এর মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়, তখন বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।

শারীরিক পরিবর্তনসমূহ:

• স্তন বৃদ্ধি (গাইনেকোমাস্টিয়া)

• শরীরের চর্বি বৃদ্ধি, বিশেষত নিতম্ব ও উরুতে

• যৌন ক্ষমতা হ্রাস

• শুক্রাণু উৎপাদন কমে যাওয়া, যা উর্বরতাকে প্রভাবিত করে

• পেশির শক্তি কমে যাওয়া

• মাথার চুল ঘন হওয়া

• ত্বকের পরিবর্তন – নরম ও মসৃণ হয়ে যাওয়া

মানসিক পরিবর্তনসমূহ:

• মেজাজ পরিবর্তন

• বিষণ্ণতা

• শক্তি ও উদ্যম কমে যাওয়া

• যৌন আকাঙ্ক্ষা হ্রাস পাওয়া

টেস্টোস্টেরন: উভয় লিঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হরমোন

টেস্টোস্টেরন মূলত পুরুষ যৌন হরমোন হিসেবে পরিচিত, কিন্তু এটি নারীদের শরীরেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা

পুরুষদের ক্ষেত্রে, টেস্টোস্টেরন নিম্নলিখিত কার্যাবলী সম্পাদন করে:

• মাংসপেশি বৃদ্ধি ও হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি

• যৌন অঙ্গের পূর্ণতা প্রদান

• বয়ঃসন্ধিকালে কণ্ঠস্বর গাঢ় হওয়া

• শুক্রাণু উৎপাদন, যা পুরুষের উর্বরতা বৃদ্ধি করে

• বগল ও শ্রোণীদেশে চুল গজায়

• গোঁফ ও দাড়ি গজানো

• বয়স্ক-টাইপ শরীরের গন্ধ উৎপন্ন করা

যখন পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমে যায়, তখন শারীরিক শক্তি কমে যায়, যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং মেজাজে পরিবর্তন দেখা দেয়।

মহিলাদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের ভূমিকা

মহিলাদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন, যথাযথ মাত্রায় থাকলে, নিম্নলিখিত কাজগুলি করে:

• ফলিকল বিকাশে সাহায্য করে

• লিবিডো বা যৌন আকাঙ্ক্ষা বজায় রাখে

• শক্তি ও সক্রিয়তা বাড়ায়

তবে যখন মহিলাদের শরীরে ডিম্বাশয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন উৎপন্ন হয়, তখন সেখান থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ টেস্টোস্টেরন তৈরি হয়। এর ফলে মহিলাদের মধ্যে পুরুষের বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়।

থাইরয়েড হরমোন ও উর্বরতার সম্পর্ক

থাইরয়েড হরমোন শুধু বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে না, প্রজনন স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। হাইপোথাইরয়েডিজম (আন্ডারঅ্যাক্টিভ থাইরয়েড) বা হাইপারথাইরয়েডিজম (ওভারঅ্যাকটিভ থাইরয়েড) এর মতো অবস্থা মাসিক চক্রকে ব্যাহত করতে পারে এবং অনিয়মিত ডিম্বস্ফোটনের কারণ হতে পারে।

একটি স্থিতিশীল হরমোন পরিবেশ গর্ভধারণ এবং প্রাথমিক গর্ভাবস্থাকে সমর্থন করে। থাইরয়েড সমস্যা থাকা নারীদের গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে এবং গর্ভাবস্থার অন্যান্য জটিলতাও দেখা দিতে পারে।

হরমোন ভারসাম্যহীনতার কারণসমূহ

হরমোন ভারসাম্যহীনতার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে:

জেনেটিক কারণ:

• বংশগত কারণে হরমোন ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে

• PCOS-এর ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও এই সমস্যা থাকতে পারে

জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত কারণ:

• অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

• অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা

• পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপের অভাব

• অতিরিক্ত চাপ ও মানসিক তনাব

• অতিরিক্ত পরিমাণে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন

হরমোন ভারসাম্যহীনতা নিয়ন্ত্রণের উপায়

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলার জন্য নানা পদ্ধতি রয়েছে:

চিকিৎসা পদ্ধতি

PCOS এবং অন্যান্য হরমোনাল সমস্যা নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। পিসিওএস থাকলে বছরে দুবার প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা করানো উচিত। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে:

• হরমোন থেরাপি

• জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (চিকিৎসকের পরামর্শে)

• অন্যান্য বিশেষ ওষুধ যা হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে

• গর্ভধারণের সমস্যার ক্ষেত্রে প্রজনন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

জীবনযাত্রার পরিবর্তন

হরমোন নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিকভাবে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে:

• নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা

• সুষম খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ

• ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, বিশেষত PCOS আক্রান্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে

• স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক যেমন যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন অনুশীলন

• ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন

সামাজিক প্রভাব ও মানসিক স্বাস্থ্য

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও সামাজিক প্রভাবও ফেলতে পারে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, যখন মুখে অতিরিক্ত লোম গজায়, তখন তা সামাজিক সমস্যা তৈরি করে। স্কুল-কলেজে যাওয়া মেয়েরা বুলিংয়ের শিকার হতে পারে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারে।

এজন্য চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক সহায়তা এবং পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। নারীদেহে পুরুষ হরমোন বেশি হলে PCOS সহ নানা জটিলতা দেখা দেয়, আবার পুরুষদেহে স্ত্রী হরমোন বেশি হলেও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। সঠিক সময়ে লক্ষণগুলি চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। হরমোন ভারসাম্যহীনতা চিহ্নিত করে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া উর্বরতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।