প্রেম নিঃসন্দেহে জীবনের অন্যতম সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু এই প্রেমই যখন তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্তি বা বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় রূপ নেয়, তখন তা শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। এই অবস্থাকেই বলা হয় লাভসিকনেস (Lovesickness) বা প্রেমজনিত অসুস্থতা। এটি কোনো কাল্পনিক বা কাব্যিক ধারণা নয়, বরং মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। চলুন, এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
লাভসিকনেস কী? (What is Lovesickness?)
লাভসিকনেস হলো এমন একটি মানসিক ও শারীরিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি ভালোবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার কারণে, তার অনুপস্থিতিতে বা সম্পর্কচ্ছেদের ফলে তীব্র আবেগগত এবং শারীরিক কষ্টে ভোগেন। যদিও এটি ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস (DSM-5) এ কোনো আনুষ্ঠানিক মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকৃত নয়, তবে এর লক্ষণগুলো অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (OCD), উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার মতো মানসিক রোগের সাথে মিলে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, লাভসিকনেস হলো এমন একটি অনুভূতি যখন ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন, কাজ ও সম্পর্ককে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডঃ ফ্র্যাঙ্ক ট্যালিস তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, লাভসিকনেসকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত, কারণ এটি গুরুতর মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
বিজ্ঞানের চোখে লাভসিকনেস: মস্তিষ্কের রসায়ন
প্রেমে পড়লে আমাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিকের ঝড় বয়ে যায়। মূলত চারটি হরমোন এর জন্য দায়ী:
- ডোপামিন (Dopamine): এটি ‘সুখের হরমোন’ নামে পরিচিত। প্রেমে পড়লে মস্তিষ্ক প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নিঃসরণ করে, যা আমাদের আনন্দিত, উত্তেজিত এবং উচ্ছ্বসিত করে তোলে। কোকেনের মতো মাদকও মস্তিষ্কের এই অংশকেই উদ্দীপ্ত করে।
- অক্সিটোসিন (Oxytocin): একে ‘লাভ হরমোন’ বা ‘আলিঙ্গনের হরমোন’ বলা হয়। এটি সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস, আকর্ষণ এবং বন্ধন তৈরি করে।
- সেরোটোনিন (Serotonin): প্রেমে পড়লে সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। OCD রোগীদের ক্ষেত্রেও সেরোটোনিনের মাত্রা কম থাকতে দেখা যায়। একারণেই ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে অবসেসিভ বা আবেশী চিন্তাভাবনা তৈরি হয়।
- কর্টিসল (Cortisol): এটি ‘স্ট্রেস হরমোন’। ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হলে বা বিচ্ছেদ ঘটলে কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়, যা উদ্বেগ, অস্থিরতা এবং শারীরিক কষ্টের কারণ হয়।
যখন ভালোবাসা একতরফা হয় বা সম্পর্ক ভেঙে যায়, তখন ডোপামিন এবং অক্সিটোসিনের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু মস্তিষ্ক তখনও তা কামনা করতে থাকে। এর ফলে এক ধরনের ‘উইথড্রয়াল সিনড্রোম’ বা প্রত্যাহারের লক্ষণ দেখা দেয়, যা মাদকাসক্ত ব্যক্তির মাদক ছাড়ার সময়ের মতো কষ্টদায়ক হতে পারে।
লাভসিকনেসের সাধারণ লক্ষণগুলো কী কী?
লাভসিকনেসের লক্ষণগুলোকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:
মানসিক ও আবেগগত লক্ষণ:
- আবেশী চিন্তা (Obsessive Thoughts): ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করা, তার স্মৃতি বা কথা বার বার মনে পড়া।
- মেজাজের চরম ওঠানামা (Mood Swings): হঠাৎ প্রচণ্ড আনন্দ আবার পরক্ষণেই গভীর দুঃখে ডুবে যাওয়া।
- উদ্বেগ ও অস্থিরতা: ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বুক ধড়ফড় করা এবং মানসিক চাপ অনুভব করা।
- মনোযোগে অক্ষমতা: কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, পড়াশোনা বা অফিসের কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটা।
- বাস্তবতাকে অস্বীকার করা: সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও তা মেনে না নেওয়া এবং সঙ্গী ফিরে আসবে এমন অলীক স্বপ্ন দেখা।
- হতাশা ও বিষণ্ণতা: নিজেকে একা, মূল্যহীন এবং অসহায় মনে করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, সম্পর্কজনিত সমস্যাগুলো বিশ্বব্যাপী বিষণ্ণতার অন্যতম প্রধান কারণ।
শারীরিক লক্ষণ:
- অনিদ্রা (Insomnia): রাতে ঘুম না আসা বা ঘুমালেও বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া।
- ক্ষুধামান্দ্য বা অতিরিক্ত ক্ষুধা: খাওয়ার রুচি একেবারে চলে যাওয়া অথবা অতিরিক্ত খাওয়া।
- বুক ব্যথা বা অস্বস্তি: মানসিক চাপের কারণে বুকে ব্যথা বা ভারী অনুভূতি হওয়া, যা ‘ব্রোকেন হার্ট সিনড্রোম’ (স্ট্রেস-ইনডিউসড কার্ডিওমায়োপ্যাথি) এর মতো হতে পারে।
- মাথা ঘোরা ও বমি বমি ভাব: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে হজমের সমস্যা এবং মাথা ঘোরানো।
- শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তি: সব সময় ক্লান্ত অনুভব করা এবং শরীরে শক্তি না পাওয়া।
আচরণগত লক্ষণ:
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি: সঙ্গীর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল বার বার দেখা বা তাকে স্টক করা।
- নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া: বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলা।
- দৈনন্দিন কাজকর্মে অনীহা: নিজের যত্ন না নেওয়া, শখের কাজগুলো ছেড়ে দেওয়া।
- অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ: বার বার ফোন করা, মেসেজ পাঠানো বা সঙ্গীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা।
লাভসিকনেস কেন হয়? এর পেছনের কারণ
বিভিন্ন কারণে একজন ব্যক্তি লাভসিকনেসে আক্রান্ত হতে পারেন। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো:
- একতরফা ভালোবাসা (Unrequited Love): যখন ভালোবাসা একপাক্ষিক হয়, তখন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় ও কষ্ট থেকে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়।
- সম্পর্কচ্ছেদ (Breakup): দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙে গেলে শূন্যতা এবং মানসিক যন্ত্রণা তৈরি হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৭০% মানুষ ব্রেকআপের পর ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের লক্ষণ অনুভব করেন।
- দূরত্বজনিত সম্পর্ক (Long-distance Relationship): সঙ্গীর থেকে দূরে থাকার কারণে সৃষ্ট একাকীত্ব এবং নিরাপত্তাহীনতা লাভসিকনেসের জন্ম দিতে পারে।
- অ্যাটাচমেন্ট স্টাইল (Attachment Style): যাদের ‘অ্যাংজিয়াস অ্যাটাচমেন্ট স্টাইল’ (Anxious Attachment Style) থাকে, তারা সঙ্গীকে হারানোর ভয়ে বেশি ভোগেন এবং তাদের লাভসিকনেসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব: যাদের আত্মসম্মান কম, তারা সম্পর্কের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং বিচ্ছেদ বা দূরত্ব সহ্য করতে পারেন না।
লাভসিকনেস থেকে মুক্তির উপায়: একটি বাস্তবসম্মত পথনির্দেশ
লাভসিকনেস একটি কষ্টদায়ক অনুভূতি হলেও সঠিক পদক্ষেপে এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। নিচে কিছু কার্যকর উপায় আলোচনা করা হলো:
১. বাস্তবতা স্বীকার করুন
প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি ধাপ হলো পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া। সম্পর্কটি যে শেষ হয়ে গেছে বা ভালোবাসাটি যে একতরফা, এই সত্যটি যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করবেন, তত দ্রুত নিরাময়ের পথে এগোতে পারবেন।
২. ‘নো কন্টাক্ট’ নিয়ম অনুসরণ করুন
প্রাক্তন সঙ্গী বা যার প্রতি আপনি আবেশ বোধ করছেন, তার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিন। ফোন নম্বর, সোশ্যাল মিডিয়া এবং তার স্মৃতি বিজড়িত সব জিনিস থেকে দূরে থাকুন। এটি আপনাকে আবেগগতভাবে দূরত্ব তৈরি করতে এবং নিজেকে নিয়ে ভাবার সুযোগ দেবে।
৩. নিজের যত্ন নিন (Self-Care)
- ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন। ব্যায়াম মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যা মন ভালো রাখতে সাহায্য করে।
- সুষম খাবার: পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। মানসিক চাপে থাকাকালীন জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুম আপনার মানসিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে।
৪. নতুন রুটিন তৈরি করুন
পুরনো রুটিন আপনাকে பழைய স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। তাই নতুন শখ তৈরি করুন। নতুন কোনো ভাষা শিখুন, জিমে ভর্তি হোন, ছবি আঁকুন বা ভলান্টিয়ারি কাজ করুন। ব্যস্ত থাকলে আবেশী চিন্তা থেকে মন দূরে থাকবে।
৫. সামাজিক হোন
নিজেকে একা রাখবেন না। বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সময় কাটান। আপনার অনুভূতিগুলো বিশ্বস্ত কারো সাথে শেয়ার করুন। মানুষের সাথে মিশলে একাকীত্ব দূর হয় এবং মানসিক সমর্থন পাওয়া যায়।
৬. মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন
মাইন্ডফুলনেস বা ধ্যান বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগ দিতে শেখায়। এটি আপনাকে অতিরিক্ত চিন্তা এবং উদ্বেগ থেকে মুক্তি দিয়ে মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন মেডিটেশন অ্যাপ বা ইউটিউব ভিডিওর সাহায্য নিতে পারেন।
৭. বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন
যদি উপরের কোনো পদ্ধতিতেই আপনার অবস্থার উন্নতি না হয় এবং এটি আপনার দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে, তবে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না। কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি (CBT) এই ধরনের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে অত্যন্ত কার্যকর।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন: লাভসিকনেস কি একটি মানসিক রোগ? উত্তর: না, লাভসিকনেস আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মানসিক রোগ নয়। তবে এর লক্ষণগুলো গুরুতর হলে তা বিষণ্ণতা বা উদ্বেগজনিত রোগের কারণ হতে পারে।
প্রশ্ন: লাভসিকনেস থেকে বের হতে কত সময় লাগে? উত্তর: এর কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এটি ব্যক্তি, সম্পর্কের গভীরতা এবং তার মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে সঠিক পদক্ষেপ নিলে কয়েক মাস থেকে এক বছরের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব।
প্রশ্ন: লাভসিকনেস কি শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে? উত্তর: হ্যাঁ, তীব্র মানসিক চাপ কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, হজমের সমস্যা তৈরি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
প্রশ্ন: কাউকে ভুলতে না পারা কি লাভসিকনেসের লক্ষণ? উত্তর: হ্যাঁ, সম্পর্ক শেষ হওয়ার অনেকদিন পরেও যদি কাউকে নিয়ে আবেশী চিন্তা আসে এবং দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব পড়ে, তবে তা লাভসিকনেসের একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
উপসংহার
ভালোবাসা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, তবে এর কারণে নিজের জীবনকে স্থবির করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লাভসিকনেস একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা, কিন্তু এটি চিরস্থায়ী নয়। নিজের প্রতি যত্নশীল হয়ে, বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এবং প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই অবস্থা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব। মনে রাখবেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটি হলো আপনার নিজের সাথে। তাই নিজেকে ভালোবাসুন এবং একটি সুস্থ, সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলুন।