Indain National Dish: ভারতের রাস্তার ধারে একটি ছোট্ট দোকানে বসে আপনি যখন গরম গরম খিচুড়ি খাচ্ছেন, তখন কি কখনও ভেবেছেন এই সাধারণ খাবারটির পিছনে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস? আজ আমরা আপনাকে নিয়ে যাব এক অসাধারণ যাত্রায়, যেখানে আপনি জানতে পারবেন কেন খিচুড়িকে ভারতের জাতীয় খাবার বলা হয় এবং এর পিছনের গল্পটা কি।খিচুড়ি শুধু একটি খাবার নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায় ‘খিচ্চা’ নামে, যা ছিল ভাত ও ডাল দিয়ে তৈরি একটি পদ। কালের বিবর্তনে এই খাবারটি বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে, কিন্তু এর মূল উপাদান – ভাত ও ডাল – অপরিবর্তিত রয়েছে।খিচুড়ির ইতিহাস শুধু ভারতের সীমানায় আবদ্ধ নয়। ১৪ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা ভারত ভ্রমণকালে এই খাবারের উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “মুঞ্জ (মুগ ডাল) ভাতের সাথে সিদ্ধ করে, তারপর ঘি দিয়ে খাওয়া হয়। তারা এটাকে কিশরি বলে, এবং প্রতিদিন সকালে খায়।”
ঠান্ডা রাখুন, পরিষ্কার রাখুন: আপনার ফ্রিজের আয়ু বাড়ানোর গোপন কৌশল
এর প্রায় শতবর্ষ পরে, ১৪৬৯ সালে, রাশিয়ান ব্যবসায়ী আফানাসি নিকিতিন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছিলেন যে ঘোড়াদেরও খিচুড়ি খাওয়ানো হত।খিচুড়ির জনপ্রিয়তা শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মুঘল সম্রাটরাও এই খাবারের প্রতি দুর্বল ছিলেন। সম্রাট আকবর খিচুড়ির একজন বড় ভক্ত ছিলেন। তাঁর দরবারে খিচুড়ি একটি বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল। জাহাঙ্গীর পছন্দ করতেন ‘লাজিজান’ নামে পরিচিত গুজরাটি স্টাইলের খিচুড়ি, যা শুকনো ফল ও মশলা দিয়ে তৈরি হত।খিচুড়ির এই যাত্রা শুধু রাজপ্রাসাদেই থেমে থাকেনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এই খাবার ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায় এবং সেখানে ‘কেডগেরি’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এটি এখনও ব্রিটিশ ব্রেকফাস্ট মেনুতে একটি জনপ্রিয় আইটেম।খিচুড়ির পুষ্টিগুণও উল্লেখযোগ্য। ১০০ গ্রাম খিচুড়িতে রয়েছে প্রায় ১৪-১৫০ ক্যালরি, ২২.৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৩.৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ৪-৫ গ্রাম প্রোটিন। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি এবং আয়রন। এই পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবার জন্যই উপযোগী।খিচুড়ির বৈচিত্র্য এর একটি বড় আকর্ষণ। ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে এর নিজস্ব সংস্করণ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এটি ‘খিচুড়ি’ নামে পরিচিত, কর্ণাটকে ‘বিসিবেলেভাত’, তামিলনাড়ুতে ‘পোঙ্গল’, এবং উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অংশে ‘খিচড়ি’ নামে পরিচিত।
প্রতিটি সংস্করণের স্বাদ ও প্রস্তুত প্রণালী আলাদা, কিন্তু মূল উপাদান একই – ভাত ও ডাল।খিচুড়ির এই বহুমুখী ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার কারণেই অনেকে এটিকে ভারতের জাতীয় খাবার হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভারত সরকার কোনো নির্দিষ্ট খাবারকে দেশের জাতীয় খাবার হিসেবে ঘোষণা করেনি। তাই খিচুড়িকে ভারতের জাতীয় খাবার বলা যথার্থ নয়।তবে খিচুড়ির গুরুত্ব কমে যায় না এতে। এটি ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে একসূত্রে বেঁধেছে।
এর সহজলভ্যতা, পুষ্টিগুণ এবং স্বাদের কারণে এটি সর্বজনপ্রিয়।শেষ পর্যন্ত বলা যায়, খিচুড়ি হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের জাতীয় খাবার নয়, কিন্তু এটি নিঃসন্দেহে ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতির একটি প্রতীক। এটি শুধু একটি খাবার নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। তাই পরবর্তী বার যখন আপনি একবাটি গরম খিচুড়ি খাবেন, মনে রাখবেন, আপনি শুধু একটি খাবার নয়, বরং হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্বাদ নিচ্ছেন।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে খিচড়ির বিভিন্ন সংস্করণ
১. বাজরা খিচড়ি (রাজস্থান)
রাজস্থানের বাজরা খিচড়ি একটি অনন্য খাবার যা প্রধানত বাজরা (মিলেট) দিয়ে তৈরি হয়। অন্যান্য অঞ্চলের খিচড়ির মতো এতে চাল ব্যবহৃত হয় না। এটি সাধারণত শীতকালে খাওয়া হয় এবং রসুনের চাটনি বা দইয়ের সাথে পরিবেশন করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটি শুকনো ফল দিয়ে সাজানো হয়, যা এর স্বাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
২. গুজরাটি খিচড়ি (গুজরাট)
গুজরাটের খিচড়ি সাধারণত নরম এবং মাখনের মতো মসৃণ হয়। এটি চাল এবং ডাল দিয়ে তৈরি হয় এবং গুজরাটের আরামদায়ক খাবার সংস্কৃতির একটি অংশ। গুজরাটি খিচড়ি সাধারণত মিষ্টি এবং ঝাল দুই ধরনের হয় এবং এটি সাধারণত মিষ্টি গুজরাটি কড়ির সাথে পরিবেশন করা হয়।
৩. পঙ্গল (তামিলনাড়ু)
তামিলনাড়ুর পঙ্গল একটি মশলাদার খাবার যা চাল এবং ডাল দিয়ে তৈরি হয়। এটি পঙ্গল উৎসবে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। পঙ্গল সাধারণত ঘি দিয়ে সাজানো হয় এবং এটি মিষ্টি এবং ঝাল দুই ধরনের হয়। মিষ্টি পঙ্গল, যা চাকারাই পঙ্গল নামে পরিচিত, তাতে গুড় ব্যবহার করা হয়।
৪. বিহারি খিচড়ি (বিহার)
বিহারের খিচড়ি বিভিন্ন ডাল এবং সবজি দিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত সরল এবং পুষ্টিকর হয়। বিহারি খিচড়ি মকর সংক্রান্তি উৎসবে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এটি সাধারণত চোকা (আলু এবং বেগুন দিয়ে তৈরি একটি পদ) এর সাথে পরিবেশন করা হয়।
৫. খিচুড়ি (পশ্চিমবঙ্গ)
পশ্চিমবঙ্গের খিচুড়ি, যা ভোগের খিচুড়ি নামেও পরিচিত, সাধারণত পূজার সময় দেবতাদের নিবেদন করা হয়। এটি চাল, মুগ ডাল, আদা এবং প্রচুর পরিমাণে ঘি দিয়ে তৈরি হয়। খিচুড়ির একটি মিষ্টি স্বাদ রয়েছে এবং এটি টমেটো চাটনি এবং ভাজা ইলিশ মাছের সাথে পরিবেশন করা হয়।
৬. কিমা খিচড়ি (অন্ধ্রপ্রদেশ)
অন্ধ্রপ্রদেশের কিমা খিচড়ি একমাত্র নন-ভেজেটেরিয়ান খিচড়ি। এটি হায়দ্রাবাদের নিজামদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল এবং এটি হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির মতো স্বাদযুক্ত। তবে এটি ভিন্নভাবে রান্না করা হয়। কিমা খিচড়ি সাধারণত খাট্টা (একটি টক সাইড ডিশ) এর সাথে পরিবেশন করা হয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তির পথ কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলবেন?
৭. তিল খিচড়ি (উত্তরাখণ্ড)
উত্তরাখণ্ডের তিল খিচড়ি, যা তিলোথু নামেও পরিচিত, কালো তিলের বীজ দিয়ে তৈরি হয়। তিলের বীজ, জিরা, ধনে, লবঙ্গ এবং কালো মরিচ শুকনো ভাজা হয় এবং তারপর আদা, রসুন এবং সবুজ মরিচ দিয়ে পেস্ট তৈরি করা হয়। এই মশলাগুলি উরদ ডাল এবং চালের খিচড়িকে অসাধারণ স্বাদ দেয়।
৮. বারদোলি খিচড়ি (গুজরাট)
গুজরাটের বারদোলি খিচড়ি একটি মশলাদার খিচড়ি যা চাল, তুর ডাল বা অড়হর ডাল এবং কাঁচা আম দিয়ে তৈরি হয়। এতে লাল মরিচ, জিরা, সবুজ মরিচ, হিং, আদা এবং হলুদ গুঁড়ো যোগ করা হয়। কাঁচা আমের সংযোজন খিচড়িটিকে টক স্বাদ দেয়।
Best Superfoods: গোপন সুপারফুড ফর্মুলা ফাঁস – সেলিব্রিটিরা যা খায় তা এখন
৯. মং কেচির (লাদাখ)
লাদাখের মং কেচির একটি বিশেষ খিচড়ি যা মুগ ডাল এবং চাল দিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত শীতকালে খাওয়া হয় এবং এতে মশলার ব্যবহার কম হয়।
১০. ভোগের খিচুড়ি (পশ্চিমবঙ্গ)
পশ্চিমবঙ্গের ভোগের খিচুড়ি সাধারণত পূজার সময় দেবতাদের নিবেদন করা হয়। এটি সত্ত্বিক এবং মুগ ডাল, চাল, আদা এবং প্রচুর পরিমাণে ঘি দিয়ে তৈরি হয়।
১১. ওলাচি খিচড়ি (মহারাষ্ট্র)
মহারাষ্ট্রের ওলাচি খিচড়ি একটি বিশেষ খিচড়ি যা চাল, মুগ ডাল এবং ওলা (এক ধরনের সবজি) দিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত মশলাদার এবং পুষ্টিকর হয়।
১২. ভুনা কিমা খিচড়ি (বোহরা সম্প্রদায়)
বোহরা সম্প্রদায়ের ভুনা কিমা খিচড়ি একটি বিশেষ খিচড়ি যা ভুনা কিমা, হলুদ ডাল, সিদ্ধ ডিম এবং ভাজা আলু দিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত শীতকালে খাওয়া হয় এবং এটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের খিচড়ির নিজস্ব বৈচিত্র্য রয়েছে, যা প্রতিটি সংস্কৃতির স্বাদ ও ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। এই সমস্ত খিচড়ির সংস্করণগুলি ভারতের খাদ্য সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সমৃদ্ধিকে তুলে ধরে।