বর্তমান ভারতীয় শেয়ার বাজারে IPO (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং)-এর জোয়ার চলছে। সম্প্রতি LG ইলেকট্রনিক্স ইন্ডিয়ার মতো বড় আইপিও মাত্র ৬.৫ ঘন্টার মধ্যে ওভারসাবস্ক্রাইবড হয়ে ১৭ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে, যা বাজারের উত্তেজনা প্রমাণ করে। অনেকেই আইপিও-কে দ্রুত বড়লোক হওয়ার সহজ উপায় বলে মনে করেন। খবরের কাগজে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘লিস্টিং গেইন’ (Listing Gain) বা প্রথম দিনেই শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হওয়ার গল্প শুনে নতুন বিনিয়োগকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠও আছে। ২০২৩-২৪ সালের ডেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেখানে কিছু আইপিও যেমন Vibhor Steel Tubes বিনিয়োগকারীদের ১৮১% লিস্টিং গেইন দিয়েছে, সেখানে MVK Agro Food Product-এর মতো আইপিও প্রথম দিনেই বিনিয়োগকারীদের ৩৪% লোকসান করিয়েছে। এই বছর প্রায় অর্ধেক আইপিও তাদের ইস্যু মূল্যের নিচে ট্রেড করছে। তাই, আইপিও-তে বিনিয়োগ করা কোনো লটারি নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া। এই প্রবন্ধে আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব যে একটি আইপিও-তে বিনিয়োগ করার আগে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত, যাতে আপনি হাইপ (Hype) এড়িয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
IPO কী এবং কোম্পানিগুলি কেন এটি অফার করে?
সহজ ভাষায়, ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (IPO) হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি প্রাইভেট কোম্পানি প্রথমবার সাধারণ মানুষের কাছে তার শেয়ার বিক্রি করে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। এটি প্রাইমারি মার্কেটে (Primary Market) ঘটে। একবার শেয়ারগুলি স্টক এক্সচেঞ্জে (যেমন NSE বা BSE) তালিকাভুক্ত হয়ে গেলে, সেগুলি সেকেন্ডারি মার্কেটে (Secondary Market) কেনা-বেচা করা যায়, যেখানে আমরা সাধারণত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করি।
কোম্পানিগুলির আইপিও আনার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে:
- মূলধন সংগ্রহ (Capital Raising): কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ, নতুন প্রজেক্ট শুরু করা বা নতুন প্রযুক্তি কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়।
- ঋণ পরিশোধ (Debt Repayment): অনেক সময় কোম্পানিগুলি তাদের পুরনো ঋণ শোধ করার জন্য বাজার থেকে টাকা তোলে।
- বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের প্রস্থান (Provide Exit): প্রমোটার, অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (VC) ফার্মগুলি তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ থেকে লাভ তুলে নেওয়ার জন্য আইপিও-এর মাধ্যমে তাদের শেয়ার বিক্রি করে (যাকে অফার ফর সেল বা OFS বলে)।
- ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধি (Brand Value): স্টক মার্কেটে লিস্টেড হলে কোম্পানির স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ব্র্যান্ডের পরিচিতি বাড়ে।
IPO-তে বিনিয়োগের আগে মূল্যায়নের চাবিকাঠি
একটি আইপিও-তে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, শুধুমাত্র গ্রে মার্কেট প্রিমিয়াম (GMP) বা বন্ধুদের কথায় বিশ্বাস না করে, আপনাকে একজন গোয়েন্দার মতো কোম্পানির হাঁড়ির খবর জানতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি হল DRHP।
১. DRHP/RHP: কোম্পানির ‘জন্মপত্রিকা’ বিশ্লেষণ
DRHP (Draft Red Herring Prospectus) হল একটি আইনি নথি যা কোম্পানিকে আইপিও আনার আগে বাধ্যতামূলকভাবে SEBI (Securities and Exchange Board of India)-এর কাছে জমা দিতে হয়। SEBI-এর অনুমোদনের পর এটি RHP (Red Herring Prospectus) হয়ে ওঠে। এই শত শত পাতার নথিটিই হল কোম্পানির আসল ‘জন্মপত্রিকা’। আপনি এটি SEBI, BSE বা NSE-এর ওয়েবসাইট থেকে সহজেই ডাউনলোড করতে পারবেন।
আপনাকে পুরো নথিটি পড়তে হবে না, তবে এই কয়েকটি বিভাগ অবশ্যই পড়তে হবে:
- About the Company (কোম্পানির পরিচিতি): কোম্পানিটি ঠিক কী ব্যবসা করে? তাদের প্রধান পণ্য বা পরিষেবা কী? তাদের ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন (USP) কী? তারা কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে এবং সেই ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ কেমন?
- Objects of the Issue (আইপিও-এর উদ্দেশ্য): এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোম্পানি আপনার টাকা নিয়ে কী করবে? এখানে দুটি প্রধান ভাগ থাকে:
- Fresh Issue (নতুন শেয়ার ইস্যু): এর মানে হল কোম্পানি নতুন শেয়ার ইস্যু করে বাজার থেকে টাকা তুলছে এবং সেই টাকা সরাসরি কোম্পানির কাছে যাবে (যেমন ব্যবসা সম্প্রসারণ বা ঋণ পরিশোধের জন্য)। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
- Offer for Sale (OFS): এর মানে হল কোম্পানির বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডাররা (প্রমোটার বা প্রাথমিক বিনিয়োগকারী) তাদের নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এই টাকা কোম্পানির কাছে যায় না। যদি আইপিও-এর বেশিরভাগ অংশই OFS হয়, তবে এটি একটি সতর্কবার্তা হতে পারে যে, পুরনো বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন কোম্পানির সেরা সময় শেষ এবং তারা এখন লাভ বুক করে বেরিয়ে যেতে চান।
- Risk Factors (ঝুঁকির তালিকা): এই বিভাগে কোম্পানি তাদের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ছোট-বড় ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে। যেমন – কোনো আইনি মামলা, নির্দিষ্ট কোনো গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, কাঁচামালের দামের ওঠানামা ইত্যাদি। এই বিভাগটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
- Financial Statements (আর্থিক বিবরণ): গত ৩ থেকে ৫ বছরের কোম্পানির আর্থিক পারফরম্যান্স দেখুন।
- Revenue (রাজস্ব): কোম্পানির আয় কি প্রতি বছর স্থিতিশীলভাবে বাড়ছে?
- Profit After Tax (PAT): কোম্পানি কি লাভজনক? লাভের পরিমাণ কি বাড়ছে? অনেক সময় কোম্পানিগুলি আইপিও-এর ঠিক আগের বছর কৃত্রিমভাবে লাভ বাড়িয়ে দেখায়। তাই গত ৩-৫ বছরের ধারাবাহিকতা দেখা জরুরি।
- Debt (ঋণ): কোম্পানির ওপর ঋণের বোঝা কেমন? তারা কি ঋণের জালে জর্জরিত?
- Management & Promoters (পরিচালনা পর্ষদ ও প্রমোটার): কোম্পানির পরিচালকদের অভিজ্ঞতা কেমন? তাদের ট্র্যাক রেকর্ড কী? প্রমোটারদের বিরুদ্ধে কোনো জালিয়াতির অভিযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখুন। আইপিও-এর পরে প্রমোটারদের হাতে কত শতাংশ শেয়ার থাকছে (Promoter Holding) সেটাও দেখুন। যদি প্রমোটাররা আইপিও-তে তাদের বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন, তবে তা একটি বড় রেড ফ্ল্যাগ।
২. ভ্যালুয়েশন: শেয়ারটি কি সস্তা না দামী?
আইপিও-তে লাভ করার অর্থ হল একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার সঠিক দামে কেনা। যদি একটি দুর্দান্ত কোম্পানির শেয়ারও খুব বেশি দামে (Overvalued) কেনা হয়, তবে লোকসানের সম্ভাবনাই বেশি।
- প্রাইস ব্যান্ড (Price Band): কোম্পানি একটি প্রাইস ব্যান্ড (যেমন, ₹২০০ – ₹২১০) ঠিক করে। রিটেল বিনিয়োগকারীদের সবসময় কাট-অফ প্রাইসে (Cut-off Price) বা আপার প্রাইস ব্যান্ডে (₹২১০) বিড করা উচিত, যাতে অ্যালটমেন্ট পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
মূল্যায়ন বোঝার জন্য এই অনুপাতগুলি দেখুন এবং সেগুলিকে একই ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য লিস্টেড কোম্পানির (Peers) সাথে তুলনা করুন:
- P/E (Price-to-Earnings) Ratio: এটি হল শেয়ারের মূল্য এবং শেয়ার প্রতি আয়ের (EPS) অনুপাত। এটি দেখায় যে আপনি কোম্পানির প্রতি ₹১ আয়ের জন্য কত টাকা প্রিমিয়াম দিতে রাজি আছেন।
- উদাহরণ: যদি আইপিও-এর আপার প্রাইস ব্যান্ডে P/E রেশিও হয় ৪০, কিন্তু তার প্রতিযোগী লিস্টেড কোম্পানিগুলির গড় P/E রেশিও হয় ২৫, তবে আইপিও-টি দামী বা ওভারভ্যালুড বলে মনে করা যেতে পারে।
- EPS (Earnings Per Share): = মোট লাভ / মোট শেয়ারের সংখ্যা। এটি কোম্পানির লাভজনকতা পরিমাপ করে।
- RoNW (Return on Net Worth): এটি দেখায় যে কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের অর্থের ওপর কতটা দক্ষতার সাথে রিটার্ন জেনারেট করছে।
- Debt-to-Equity Ratio (ঋণ-ইক্যুইটি অনুপাত): এটি কোম্পানির মোট ঋণকে তার শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটির সাথে তুলনা করে। এই অনুপাত ১-এর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
টেবিল: ভ্যালুয়েশন তুলনা (উদাহরণ)
| বৈশিষ্ট্য | IPO কোম্পানি (X) | প্রতিযোগী A (লিস্টেড) | প্রতিযোগী B (লিস্টেড) |
| P/E রেশিও | ৪৫ | ৩০ | ৩২ |
| RoNW | ১৫% | ২০% | ২২% |
| D/E রেশিও | ১.২ | ০.৫ | ০.৭ |
উপরের টেবিল অনুযায়ী, IPO কোম্পানি X তার প্রতিযোগীদের তুলনায় বেশি দামী (P/E বেশি) এবং বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (RoNW কম, ঋণ বেশি)।
৩. অ্যাঙ্কর ইনভেস্টরদের তালিকা (The Anchor Investor List)
অ্যাঙ্কর ইনভেস্টররা হল বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী (QIBs) যেমন মিউচুয়াল ফান্ড হাউস (HDFC MF, SBI MF), বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী (Goldman Sachs), বা বিমা কোম্পানি (LIC)। আইপিও সাধারণ মানুষের জন্য খোলার ঠিক একদিন আগে তাদের জন্য খোলা হয়।
- কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? এই বড় প্রতিষ্ঠানগুলি বিনিয়োগের আগে কোম্পানির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। যদি নামকরা অ্যাঙ্কর ইনভেস্টররা বড় পরিমাণে বিনিয়োগ করে, তবে এটি কোম্পানির প্রতি তাদের আস্থার প্রতিফলন ঘটায় এবং রিটেল বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি ইতিবাচক সংকেত।
- SEBI-এর নতুন নিয়ম: আগে অ্যাঙ্কর ইনভেস্টররা ৩০ দিনের মধ্যে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারতেন, যা অনেক সময় লিস্টিং-এর পরে শেয়ারের দামে পতন ঘটাত। SEBI-এর নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, অ্যাঙ্কর ইনভেস্টররা এখন তাদের ৫০% শেয়ার ৩০ দিনের আগে এবং বাকি ৫০% শেয়ার ৯০ দিনের আগে বিক্রি করতে পারবেন না। এটি দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য একটি দুর্দান্ত পদক্ষেপ।
৪. গ্রে মার্কেট প্রিমিয়াম (GMP) – আসল না নকল?
আইপিও-তে বিনিয়োগের সময় যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হল GMP (Grey Market Premium)।
- GMP কী? এটি একটি অনানুষ্ঠানিক বা আন-অফিসিয়াল বাজার যেখানে আইপিও শেয়ারগুলি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই কেনা-বেচা হয়। ধরা যাক একটি আইপিও-এর ইস্যু প্রাইস ₹১০০ এবং এর GMP চলছে ₹৪০। এর মানে হল, গ্রে মার্কেটে লোকেরা আশা করছে যে শেয়ারটি ₹১৪০ (১০০ + ৪০) মূল্যে লিস্ট হতে পারে।
- সতর্কতা: HDFC ব্যাঙ্কের মতে, গ্রে মার্কেট সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত (Unregulated) এবং শুধুমাত্র বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে চলে। এটির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অনেক সময় বড় অপারেটররা কৃত্রিমভাবে GMP বাড়িয়ে রিটেল বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করে এবং লিস্টিং-এর দিন শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যায়।
- কী করবেন? GMP-কে শুধুমাত্র বাজারের সেন্টিমেন্ট বা উত্তেজনার একটি সূচক হিসাবে দেখুন। কখনোই শুধুমাত্র GMP-এর ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করবেন না। আপনার সিদ্ধান্ত সর্বদা কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।
৫. সাবস্ক্রিপশন স্ট্যাটাস (Subscription Status)
আইপিও সাধারণত ৩ দিনের জন্য খোলা থাকে। এই সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর বিনিয়োগকারীরা আবেদন করেন। সাবস্ক্রিপশন ডেটা ট্র্যাক করা খুবই জরুরি।
- QIB (Qualified Institutional Buyers): বড় মিউচুয়াল ফান্ড, ব্যাঙ্ক।
- NII (Non-Institutional Investors): হাই নেট-ওয়ার্থ ব্যক্তি (HNI) বা বড় বিনিয়োগকারী যারা ২ লক্ষ টাকার বেশি আবেদন করেন।
- RII (Retail Individual Investors): আপনার বা আমার মতো সাধারণ বিনিয়োগকারী (২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আবেদন)।
কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
যদি QIB এবং NII কোটা কয়েকগুণ বেশি সাবস্ক্রাইব হয় (যেমন ৫০ গুণ বা ১০০ গুণ), তবে এটি একটি অত্যন্ত ইতিবাচক লক্ষণ। এর মানে হল বড় এবং স্মার্ট বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির ওপর বাজি ধরছেন। কিন্তু যদি QIB কোটা পুরোপুরি পূরণ না হয় এবং শুধুমাত্র রিটেল কোটাতেই ভিড় দেখা যায়, তবে এটি একটি বড় রেড ফ্ল্যাগ।
নতুন যুগের টেক আইপিও: একটি বিশেষ সতর্কতা
আজকাল অনেক নতুন যুগের টেকনোলজি কোম্পানি (যেমন ফুড ডেলিভারি, ফিনটেক, ই-কমার্স) আইপিও নিয়ে আসছে যারা বর্তমানে লাভজনক নয় (Loss-Making)। বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই তাদের উচ্চ গ্রোথ (Growth) দেখে বিনিয়োগ করেন, কিন্তু এখানে একটি বড় ঝুঁকি লুকিয়ে আছে।
Zerodha-এর সিইও নিতিন কামাথ (Nithin Kamath) সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, অনেক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (VC) ফার্ম “ট্যাক্স আরবিট্রেজ গেম” খেলছে।
- গেমটি কী? ভারতে, একটি কোম্পানি লাভ করলে এবং সেই লাভ ডিভিডেন্ড (Dividend) হিসাবে শেয়ারহোল্ডারদের দিলে, তার ওপর কার্যকরী ট্যাক্স প্রায় ৫২% পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু যদি কোম্পানি লাভ না দেখিয়ে সেই টাকা মার্কেটিং বা ডিসকাউন্ট দিয়ে গ্রোথ বাড়ায় এবং পরে উচ্চ ভ্যালুয়েশনে শেয়ার বিক্রি করে (ক্যাপিটাল গেইন), তবে ট্যাক্স লাগে মাত্র ১৪.৯৫%।
- বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি: এই মডেলটি কোম্পানিগুলিকে লাভের পরিবর্তে শুধুমাত্র “গ্রোথ” এবং “ভ্যালুয়েশন” বাড়ানোর দিকে ঠেলে দেয়। এই কোম্পানিগুলি টেকসই বা স্থিতিশীল (Resilient) হয় না। নিতিন কামাথের মতে, বাজারের পরিস্থিতি সামান্য খারাপ হলেই বা অর্থের জোগান বন্ধ হয়ে গেলেই এই লাভহীন কোম্পানিগুলি টিকে থাকতে সংগ্রাম করবে।
- ফলাফল: এই কারণেই আমরা দেখেছি যে অনেক হাই-প্রোফাইল টেক আইপিও লিস্টিং-এর পরে बुरीভাবে ক্র্যাশ করেছে। তাই, কোনো লস-মেকিং কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার আগে, তাদের লাভের মুখ দেখার স্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ আছে কিনা (Path to Profitability) তা DRHP-তে খতিয়ে দেখা অত্যন্ত জরুরি।
সাম্প্রতিক বাজারের তথ্য ও SEBI-এর ভূমিকা
আইপিও বাজারে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বর্তমান বাজারের পরিস্থিতি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি (২০২৪-২০২৫)
যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আইপিও বাজার খুবই সক্রিয়। একটি আকর্ষণীয় তথ্য হল, এই বাজারে এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চেয়ে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের (মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা কোম্পানি এবং রিটেল) দাপট বেশি। ২০২৪ সালের শুরু থেকে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা ৯৭৯ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করেছেন, যেখানে বিদেশি ফান্ডগুলি ৭৯০ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করেছে।
তবে, এই উত্তেজনার মধ্যেও একটি সতর্কবার্তা রয়েছে। ২০২৫ সালে লিস্টিং গেইন ২০২৩ বা ২০২৪ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়েছে এবং প্রায় ৫০% নতুন লিস্টেড কোম্পানি তাদের ইস্যু মূল্যের নিচে চলে গেছে। এটি প্রমাণ করে যে হাইপ সত্ত্বেও, প্রতিটি আইপিও লাভজনক নয়।
কেস স্টাডি: সাফল্য বনাম ব্যর্থতা (২০২৪ ডেটা)
Groww-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের পারফরম্যান্স এই ঝুঁকি এবং পুরস্কারের খেলাটিকে স্পষ্টভাবে দেখায়:
- সাফল্য (Mainboard IPO): Vibhor Steel Tubes Ltd. বিনিয়োগকারীদের প্রথম দিনেই ১৮১.৪৬% লাভ দিয়েছে। এর কারণ ছিল আকর্ষণীয় ভ্যালুয়েশন এবং কোম্পানির শক্তিশালী আর্থিক পারফরম্যান্স।
- ব্যর্থতা (SME IPO): MVK Agro Food Product Ltd. লিস্টিং-এর দিন ৩৪.১৭% ডিসকাউন্টে বা লোকসানে খোলে। এর পেছনে সম্ভবত ছিল দুর্বল ফান্ডামেন্টালস এবং অতিরিক্ত দামী ভ্যালুয়েশন।
SEBI-এর নতুন নিয়ম: বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা
রিটেল বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য SEBI ক্রমাগত নিয়মকানুন কঠোর করছে। শেয়ারখানের একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল:
- অ্যাঙ্কর ইনভেস্টরদের দীর্ঘ লক-ইন: আগে উল্লিখিত ৯০ দিনের লক-ইন নিয়মটি অ্যাঙ্করদের দ্বারা দ্রুত শেয়ার ডাম্পিং প্রতিরোধ করে বাজারকে স্থিতিশীল রাখে।
- বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের ওপর বিধিনিষেধ:
- যেসব বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের কোম্পানির ২০% -এর বেশি শেয়ার আছে, তারা OFS-এ তাদের মোট শেয়ারের ৫০% -এর বেশি বিক্রি করতে পারবেন না।
- যাদের ২০% -এর কম শেয়ার আছে, তারা ১০% -এর বেশি বিক্রি করতে পারবেন না।
এই নিয়মগুলি নিশ্চিত করে যে কোম্পানির প্রমোটার এবং প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের “স্কিন ইন দ্য গেম” (Skin in the game) থাকে, অর্থাৎ কোম্পানির ভবিষ্যতের সাথে তাদের স্বার্থ জড়িত থাকে।
আপনার কৌশল: দীর্ঘমেয়াদী না লিস্টিং গেইন?
আইপিও-তে বিনিয়োগের দুটি প্রধান কৌশল থাকতে পারে:
- লিস্টিং গেইন (Listing Gain Strategy): এই কৌশলের লক্ষ্য হল শুধুমাত্র লিস্টিং-এর দিন শেয়ার বিক্রি করে দ্রুত মুনাফা অর্জন করা। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেকটা জুয়ার মতো। এর জন্য আপনাকে GMP, সাবস্ক্রিপশন ডেটা এবং বাজারের সেন্টিমেন্টের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে হয়। যেহেতু প্রায় ৫০% আইপিও লোকসানে লিস্ট হচ্ছে, তাই এই কৌশল আপনার মূলধনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
- দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ (Long-term Investment Strategy): এটিই বিনিয়োগের সঠিক এবং টেকসই উপায়। এই কৌশলে, আপনি আইপিও-কে বাজারে লিস্টেড অন্য যেকোনো মিউচুয়াল ফান্ড বা শেয়ারের মতোই দেখেন। আপনি কোম্পানির ফান্ডামেন্টালস (ব্যবসা, লাভ, ম্যানেজমেন্ট, ভ্যালুয়েশন) গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। যদি আপনার বিশ্লেষণ বলে যে কোম্পানিটির আগামী ৫-১০ বছরে ভালো গ্রোথ করার সম্ভাবনা আছে, তবেই আপনি আইপিও-তে আবেদন করেন এবং শেয়ার পেলে তা দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে রাখেন।
আপনি যদি একজন নতুন বিনিয়োগকারী হন, তবে আপনার আর্থিক পরিকল্পনা সর্বদা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করেই করা উচিত।
সম্পূর্ণ চেকলিস্ট
আইপিও একটি দুর্দান্ত সুযোগ হতে পারে, তবে এটি একটি ফাঁদও হতে পারে। হাইপ বা উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে কখনোই বিনিয়োগ করবেন না। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের কথায় বিশ্বাস করার আগে, আপনার নিজের গবেষণা করা অপরিহার্য।
আপনার চূড়ান্ত আইপিও চেকলিস্ট:
- DRHP পড়েছেন? (বিশেষ করে ‘Objects of the Issue’ এবং ‘Risk Factors’)
- টাকা কোথায় যাচ্ছে? (Fresh Issue না OFS?)
- কোম্পানির ফান্ডামেন্টালস কেমন? (গত ৩-৫ বছরের লাভ, রাজস্ব এবং ঋণ দেখেছেন?)
- ভ্যালুয়েশন কি ঠিক আছে? (প্রতিযোগীদের সাথে P/E রেশিও তুলনা করেছেন?)
- ম্যানেজমেন্ট কি বিশ্বাসযোগ্য?
- অ্যাঙ্কর ইনভেস্টর কারা? (বড় নাম আছে কি?)
- সাবস্ক্রিপশন স্ট্যাটাস কী বলছে? (QIB কোটা পূরণ হয়েছে?)
- কোম্পানিটি কি লাভজনক? (যদি না হয়, তবে কেন এবং কবে লাভজনক হবে তার রোডম্যাপ আছে?)
- GMP-এর ওপর কতটা নির্ভর করছেন? (মনে রাখবেন, এটি অনানুষ্ঠানিক)
- আপনার লক্ষ্য কী? (লিস্টিং গেইন না দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ?)
যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর আপনার কাছে পরিষ্কার হয় এবং কোম্পানির ভবিষ্যতের ওপর আপনার আস্থা থাকে, তবেই আইপিও-তে বিনিয়োগের কথা ভাবুন।











