পিরিয়ড মিস হয়েছে? জেনে নিন পিরিয়ড না হলে কি খাওয়া উচিত (বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সহ)

প্রতি মাসে সময়মতো পিরিয়ড বা মাসিক না হওয়াটা নারীদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। জীবনযাত্রার চাপ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বা কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। অনেকেই এই সমস্যা…

Debolina Roy

 

প্রতি মাসে সময়মতো পিরিয়ড বা মাসিক না হওয়াটা নারীদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ। জীবনযাত্রার চাপ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বা কোনো শারীরিক সমস্যার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। অনেকেই এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাকৃতিক উপায়ের খোঁজ করেন। সুখবর হলো, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং কিছু নির্দিষ্ট খাবার আপনার মাসিক চক্রকে নিয়মিত করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৫-২০% নারী অনিয়মিত মাসিকের সমস্যায় ভোগেন, যার অন্যতম প্রধান কারণ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব যে, পিরিয়ড না হলে কি খাওয়া উচিত (what to eat for irregular periods) এবং কোন খাবারগুলো আপনার হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে।

অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ: প্রেক্ষাপট ও বর্তমান পরিস্থিতি

পিরিয়ড বা মাসিক চক্র দেরিতে হওয়া বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • স্ট্রেস বা মানসিক চাপ: কর্টিসল (Cortisol) নামক স্ট্রেস হরমোন বেড়ে গেলে তা শরীরের ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের উৎপাদনে বাধা দেয়, যা মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে।
  • ওজনের পরিবর্তন: হঠাৎ করে ওজন খুব বেশি বেড়ে গেলে বা কমে গেলে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
  • পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS): বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, প্রজনন বয়সের ৮-১৩% নারী PCOS-এ আক্রান্ত। এটি অনিয়মিত পিরিয়ডের একটি অন্যতম প্রধান কারণ।
  • থাইরয়েডের সমস্যা: হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম উভয়ই মাসিক চক্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
  • অতিরিক্ত ব্যায়াম: অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করলে শরীর শক্তির অভাবে ঋতুচক্র সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারে।
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি এবং অপর্যাপ্ত পুষ্টি হরমোনের সমস্যা তৈরি করে।

একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশেও শহুরে জীবনযাত্রার কারণে নারীদের মধ্যে অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা বাড়ছে। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি।

পিরিয়ড না হলে কি খাওয়া উচিত: আপনার খাদ্যতালিকায় যা যোগ করবেন

নির্দিষ্ট কিছু খাবার রয়েছে যা প্রাকৃতিকভাবে পিরিয়ড নিয়মিত করতে সাহায্য করে। এই খাবারগুলো “ইমেনাগগ” (Emmenagogue) হিসেবে পরিচিত, যা জরায়ুতে রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে মাসিক শুরু হতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক what to eat for irregular periods

১. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও সবজি

ভিটামিন সি ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়াতে এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে জরায়ুর প্রাচীর সংকুচিত হয় এবং মাসিক শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

  • পেঁপে: কাঁচা পেঁপেতে ‘পাপাইন’ নামক একটি এনজাইম থাকে যা জরায়ুর সংকোচন বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি ক্যারোটিনের একটি দারুণ উৎস, যা ইস্ট্রোজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
  • আনারস: আনারসে থাকা ‘ব্রোমেলেন’ নামক এনজাইম জরায়ুর আস্তরণকে নরম করে এবং প্রদাহ কমিয়ে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করে।
  • কমলালেবু, আমলকী ও কিউই: এই ফলগুলো ভিটামিন সি-এর চমৎকার উৎস। পিরিয়ডের সম্ভাব্য তারিখের কয়েকদিন আগে থেকে এগুলো খেলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।

২. আদা: প্রাকৃতিক উদ্দীপক

আদা একটি শক্তিশালী ইমেনাগগ হিসেবে পরিচিত। এটি জরায়ুর চারপাশের পেশীগুলোকে উদ্দীপিত করে এবং সংকোচন বাড়ায়, যা মাসিক হতে সাহায্য করে।

  • কীভাবে খাবেন: এক টুকরো তাজা আদা থেঁতো করে এক কাপ জলে ৫-৭ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এর সাথে সামান্য মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার পান করতে পারেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আদা মাসিকের সময় ব্যথা কমাতেও বেশ কার্যকরী।

৩. হলুদ: হরমোনের ভারসাম্য রক্ষাকারী

হলুদে থাকা কারকিউমিন (Curcumin) নামক উপাদানটি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং রক্ত প্রবাহ উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি অ্যান্টি-স্পাসমোডিক (anti-spasmodic) হওয়ায় মাসিকের সময়কার ব্যথা কমাতেও উপকারী।

  • কীভাবে খাবেন: এক গ্লাস গরম দুধে এক-চতুর্থাংশ চা চামচ হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে রাতে ঘুমানোর আগে পান করতে পারেন। মাসিকের সম্ভাব্য তারিখের প্রায় ১০ দিন আগে থেকে এটি শুরু করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

৪. আয়রন এবং বি-ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার

শরীরে আয়রনের ঘাটতি বা অ্যানিমিয়া (Anemia) অনিয়মিত মাসিকের একটি বড় কারণ। আয়রন এবং বি-ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার মাসিক চক্রকে নিয়মিত করতে সাহায্য করে।

  • পালং শাক ও অন্যান্য সবুজ শাক: এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড থাকে।
  • ডাল ও মটরশুঁটি: প্রোটিন ও আয়রনের দারুণ উৎস।
  • ডিম ও মুরগির মাংস: ভিটামিন B12 এবং আয়রন সরবরাহ করে।
  • বীট: বীটের রস শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।

৫. স্বাস্থ্যকর ফ্যাট (Healthy Fats)

স্বাস্থ্যকর ফ্যাট হরমোন উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

  • বাদাম ও বীজ: চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্স সিড (তিসি), এবং আখরোট ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস।
  • ঘি ও অ্যাভোকাডো: এগুলো স্বাস্থ্যকর মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের উৎস যা হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।

৬. অন্যান্য সহায়ক খাবার ও পানীয়

  • দারুচিনি: এটি শরীরের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে সাহায্য করে, যা PCOS আক্রান্ত নারীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। গরম জলে দারুচিনি গুঁড়ো মিশিয়ে পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
  • মৌরি: এক গ্লাস জলে এক চামচ মৌরি সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে পান করলে এটি জরায়ুর সংকোচন বাড়াতে সাহায্য করে।
  • অ্যালোভেরা: অ্যালোভেরার রস হরমোন নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ কার্যকর। তবে পিরিয়ড চলাকালীন এটি খাওয়া উচিত নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও কেস স্টাডি

বাংলাদেশ এন্ডোক্রাইন সোসাইটি এবং ভারতের বিভিন্ন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা একমত যে, জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রায় ৭০% অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

পুষ্টিবিদ ডঃ অঞ্জলি মুখার্জির মতে, “প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি এবং ট্রান্স-ফ্যাট এড়িয়ে চলা হরমোনের স্বাস্থ্যের জন্য প্রথম পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি একটি সুষম খাদ্যতালিকা, যেখানে পর্যাপ্ত প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেলস থাকবে, তা মাসিক চক্রকে স্বাভাবিক করতে পারে।”

একটি কেস স্টাডিতে দেখা গেছে, ২২ বছর বয়সী একজন PCOS আক্রান্ত নারী, যিনি গত ৬ মাস ধরে অনিয়মিত মাসিকের সমস্যায় ভুগছিলেন, তিনি তার খাদ্যতালিকা থেকে সাদা চিনি ও ময়দা বাদ দিয়ে এবং প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করে মাত্র ৩ মাসের মধ্যে তার মাসিক চক্র নিয়মিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

জীবনযাত্রার উপর প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

শুধু খাবারই নয়, আপনার সম্পূর্ণ জীবনযাত্রাই মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে।

  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। ঘুমের সময় শরীর হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: যোগা, হাঁটা বা হালকা কার্ডিও ব্যায়াম করুন। অতিরিক্ত ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন।
  • মানসিক চাপ কমানো: মেডিটেশন, প্রাণায়াম বা আপনার পছন্দের কোনো শখের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন।
  • সঠিক ওজন বজায় রাখা: আপনার উচ্চতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন।

ভবিষ্যতে, নারীদের উচিত তাদের মাসিক চক্রকে একটি স্বাস্থ্য সূচক হিসেবে দেখা। যেকোনো অনিয়মকে অবহেলা না করে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQ)

১. পেঁপে খেলে কি সত্যি পিরিয়ড হয়?

উত্তর: হ্যাঁ, কাঁচা পেঁপেতে থাকা ‘পাপাইন’ নামক এনজাইম জরায়ুর সংকোচন বাড়িয়ে মাসিক শুরু হতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর নাও হতে পারে।

২. পিরিয়ড না হলে গরম জল খেলে কি কোনো লাভ হয়?

উত্তর: গরম জল সরাসরি পিরিয়ড শুরু করতে সাহায্য করে না। তবে এটি তলপেটের পেশীগুলোকে শিথিল করে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, যা মাসিকের ব্যথা কমাতে এবং শরীরকে আরাম দিতে সহায়ক হতে পারে।

৩. কতদিন পিরিয়ড না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?

উত্তর: যদি আপনার মাসিক চক্র সাধারণত নিয়মিত থাকে কিন্তু হঠাৎ করে ৭-১০ দিনের বেশি দেরি হয়, অথবা যদি পরপর তিন মাস পিরিয়ড বন্ধ থাকে (অ্যামেনোরিয়া), তাহলে অবশ্যই একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৪. কোনো খাবার কি পিরিয়ড একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে?

উত্তর: কোনো নির্দিষ্ট খাবার পিরিয়ড পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় না। তবে দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টি, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে, যা অনিয়মিত পিরিয়ড বা অ্যামেনোরিয়ার কারণ হতে পারে।

৫. পিরিয়ড নিয়মিত করতে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?

উত্তর: অতিরিক্ত ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, অতিরিক্ত লবণাক্ত খাবার, প্রক্রিয়াজাত মাংস, সাদা চিনি এবং ময়দার তৈরি খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এগুলো শরীরে প্রদাহ বাড়ায় এবং হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

অনিয়মিত পিরিয়ড একটি সাধারণ সমস্যা হলেও একে অবহেলা করা উচিত নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এই সমস্যার প্রাকৃতিক এবং কার্যকরী সমাধান হতে পারে। এই প্রবন্ধে আলোচিত পিরিয়ড না হলে কি খাওয়া উচিত (what to eat for irregular periods) বিষয়ক পরামর্শগুলো আপনার মাসিক চক্রকে নিয়মিত করতে সাহায্য করবে। তবে মনে রাখবেন, যদি এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা এর সাথে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, মুখে অবাঞ্ছিত লোম বা ব্রণর মতো সমস্যা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ এর পেছনে PCOS বা থাইরয়েডের মতো গুরুতর শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে, যার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন।

About Author
Debolina Roy

দেবলীনা রায় একজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক, যিনি স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করা দেবলীনা তার লেখায় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল তথ্যগুলি সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেন, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য এবং উপকারী। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, এবং রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান এবং প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দেবলীনা রায়ের লক্ষ্য হল সঠিক ও তথ্যনির্ভর স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করা এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।