Shravan Monday fasting food list: শ্রাবণ মাসের আগমনের সাথে সাথেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শুরু হয় বিশেষ উৎসাহ ও ভক্তিপ্রদর্শনের আয়োজন। বিশেষ করে শ্রাবণ মাসের সোমবার কি কি খাওয়া যায় এই প্রশ্নটি প্রতিটি ভক্তের মনে জাগে, যারা মহাদেব শিবের প্রসন্নতা লাভের আশায় নিয়মিত উপবাস পালন করেন। এই পবিত্র মাসে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বরং স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা জানব শ্রাবণ সোমবারের উপবাসে কোন খাবারগুলি গ্রহণ করা যায় এবং কোনগুলি এড়িয়ে চলা উচিত।
শ্রাবণ মাসের সোমবার উপবাসের গুরুত্ব
শ্রাবণ মাস হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত পবিত্র একটি সময়। এই মাসটিকে মহাদেব শিবের প্রিয় মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুরাণ অনুসারে, এই মাসেই সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এবং সেই সময় উৎপন্ন বিষ মহাদেব নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। এই কারণেই তিনি নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত হন।
শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিনগুলিতে উপবাস পালন করলে সকল মনস্কামনা পূরণ হয় এবং জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান মিলে। তাই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই বিশেষ দিনগুলিতে নিয়ম মেনে উপবাস পালন করেন।
শ্রাবণ সোমবারে যা খাওয়া যায়
ফল ও ফলের প্রস্তুতি
শ্রাবণ সোমবারের উপবাসে ফল এবং ফলের সালাদ খাওয়া সবচেয়ে উত্তম। বিভিন্ন প্রকার মৌসুমী ফল যেমন আম, কলা, আপেল, আঙুর, পেয়ারা এবং অন্যান্য ফল স্বাধীনভাবে খেতে পারেন। এছাড়াও ফলের রস তৈরি করে পান করা যায়, তবে প্যাকেটজাত ফলের রস এড়িয়ে চলা উচিত।
খেজুর উপবাসের সময় অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার। এটি তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করে এবং ক্ষুধা নিবারণে সাহায্য করে। কলার স্মুদি বা ফলের রায়তাও তৈরি করে খেতে পারেন।
দুগ্ধজাত খাবার
দুধ এবং সকল প্রকার দুগ্ধজাত দ্রব্য শ্রাবণ সোমবারের উপবাসে অত্যন্ত শুভ। তবে কাঁচা দুধ খাওয়া নিষিদ্ধ – এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দই, ছানা, পনির, মাখন, ঘি এবং ক্ষীর খাওয়া যায়।
মাখানার পায়েস তৈরি করতে পারেন, যা অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং উপবাসের জন্য আদর্শ। দুধের সাথে বিভিন্ন ফল মিশিয়ে স্মুদি তৈরি করাও একটি চমৎকার বিকল্প।
বিশেষ শস্য ও দানা জাতীয় খাবার
সাবুদানা শ্রাবণ সোমবারের উপবাসে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার। সাবুদানা খিচড়ি, সাবুদানা ভাজা, বা সাবুমাখা বিভিন্নভাবে প্রস্তুত করে খেতে পারেন।
বাজরা এবং পানিফলের ময়দা দিয়ে তৈরি খাবার খাওয়া যায়। এছাড়াও বিশেষ ধরনের চাল যেমন মোরধান বা শামা চালের ভাত খাওয়ার অনুমতি রয়েছে।
আতপ চাল এবং যব শিবলিঙ্গে অর্পণ করার পাশাপাশি প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
সবজি ও অন্যান্য
আলু, লাউ এবং কুমড়ো জাতীয় সবজি শ্রাবণ সোমবারে খাওয়া যায়। কাঁচা কলার টিক্কিও একটি উত্তম বিকল্প।
বাদাম জাতীয় খাবার যেমন কাজু বাদাম, আমন্ড, আখরোট, এবং নারকেল অবাধে খেতে পারেন। এগুলি প্রোটিনের চমৎকার উৎস এবং উপবাসের সময় শক্তি প্রদান করে।
লবণ ও মশলা
সাধারণ নুনের বদলে সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করতে হবে। মশলার মধ্যে জিরা, দারুচিনি, সবুজ এলাচ, লবঙ্গ এবং কালো গোলমরিচ ব্যবহার করা যায়।
শ্রাবণ সোমবারে যা খাওয়া যাবে না
আমিষ খাবার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
শ্রাবণ মাসে মাংস, মাছ, ডিম এবং সকল প্রকার আমিষ খাবার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এই নিয়ম কেবল সোমবার নয়, বরং পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে মেনে চলা উচিত।
নিষিদ্ধ সবজি ও শাক
বেগুন খাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এর পেছনে ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে – বর্ষাকালে বেগুনে পোকা ধরার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজি এড়িয়ে চলুন। বর্ষাকালে এগুলিতে ব্যাকটেরিয়া ও পোকামাকড়ের সংক্রমণ বেশি হয়।
নিষিদ্ধ মশলা ও তেল
পিঁয়াজ, রসুন এবং অন্যান্য তীব্র গন্ধযুক্ত মশলা খাওয়া যাবে না। সর্ষের তেল, তিলের তেল এবং অন্যান্য তেল ব্যবহার করা উচিত নয়।
মুসুর ডাল এবং অন্যান্য ডাল জাতীয় খাবারও নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে।
অন্যান্য নিষিদ্ধ খাবার
গম, সাধারণ চাল, ময়দা, ওটস, বার্লি জাতীয় শস্য খাওয়া যাবে না। অ্যালকোহল, তামাক সেবন সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়।
স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
শ্রাবণ মাসের সোমবার উপবাস পালনের ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও রয়েছে। আয়ুর্বেদ অনুসারে, এই সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই নিরামিষ ও হালকা খাবার গ্রহণ করলে পাচনতন্ত্র সুস্থ থাকে।
ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায়। হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
উপবাস পালনের গুরুত্বপূর্ণ টিপস
পর্যাপ্ত পানি পান করুন
উপবাসের সময় হাইড্রেটেড থাকা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত বিরতিতে জল, ডাবের জল, বা আখের রস পান করুন। তবে প্যাকেটজাত পানীয় এড়িয়ে চলুন।
নিয়মিত বিরতিতে খাবার গ্রহণ
সারাদিন একেবারে না খেয়ে থাকার পরিবর্তে প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর ফল বা অনুমোদিত খাবার গ্রহণ করুন। এতে শরীর চাঙ্গা থাকবে এবং দুর্বলতা বোধ হবে না।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন
উপবাসের দিন ৭-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিলে ক্ষুধা কম পাবে এবং শরীর সুস্থ থাকবে।
ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখুন
উপবাসের সময় আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনায় মনোনিবেশ করুন। শিব মন্ত্র জপ, ধ্যান এবং ভক্তিমূলক গান শোনা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
উপবাস ভাঙার নিয়ম
সূর্যাস্তের পর ধীরে ধীরে উপবাস ভাঙুন। প্রথমে অল্প পরিমাণ জল পান করুন, তারপর ফল বা হালকা খাবার গ্রহণ করুন। হঠাৎ করে ভারী খাবার খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে।
মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে ইচ্ছে হলে খেজুরের পায়েস বা ফলের রায়তা খেতে পারেন। চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করুন।
বিশেষ সতর্কতা
যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, তারা উপবাস পালনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্যও বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।
শ্রাবণ মাসের সোমবার কি কি খাওয়া যায় এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা দেখলাম যে, সঠিক নিয়ম মেনে উপবাস পালন করলে ধর্মীয় পুণ্য লাভের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত উপকারও পাওয়া যায়। মূল কথা হলো, নিরামিষ ও প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ করা এবং সকল প্রকার আমিষ ও নিষিদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলা।মহাদেব শিবের প্রসন্নতা লাভ এবং জীবনে শান্তি-সমৃদ্ধি আনতে এই নিয়মগুলি যথাযথভাবে পালন করুন। মনে রাখবেন, উপবাস শুধু খাদ্য বিধি পালন নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক সাধনা যা মন ও শরীর উভয়কেই পবিত্র করে তোলে।