রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (২১ জুলাই ২০২৫) দুপুর ১টা ১৫ মিনিটের দিকে ঘটা এই ঘটনায় পাইলটসহ ১৯ জন নিহত এবং ১৬৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৬ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক এবং বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম রয়েছেন।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) বিবৃতি অনুযায়ী, বিমানটি সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী ঘাঁটি থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে উড্ডয়ন করে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
দুর্ঘটনার মুহূর্তে স্কুলে ক্লাস চলছিল এবং ক্যান্টিনে অনেক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। বিমানটি স্কুলের দোতলা ভবনের ছাদে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও আগুন লেগে যায়। যেহেতু বিমানটি সদ্য উড্ডয়ন করেছিল, এতে প্রচুর জ্বালানি ছিল, যা আগুনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এই কারণেই এত বেশি প্রাণহানি ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সর্বশেষ মুহূর্তে বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে আইএসপিআর। তিনি বিমানটিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন যাতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি সফল হতে পারেননি এবং বিমানটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জাদুঘর: সাপ্তাহিক বন্ধ, টিকিট মূল্য ও সময়সূচি
ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব এবং বিমান বাহিনীর উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আগুন নিভানো এবং আহতদের উদ্ধারে তারা যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। আহতদের বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার এবং অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এবং রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পরিকল্পিত নাকি নিছক দুর্ঘটনা? – এ বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও সরকারি সূত্র স্পষ্টভাবে জানিয়েছে এটি একটি নিছক দুর্ঘটনা। আইএসপিআর বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলেছে যে, বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় এবং পাইলট ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। তবে দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে বিমান বাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার খবরে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমেছে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক প্রকাশ করে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) একদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন। তিনি আহতদের সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যাদের মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তাদের পরিবারের কাছে দ্রুত হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিয়েছেন।
বিমান বাহিনী প্রধান সরকারি সফরে দেশের বাইরে থাকায়, সহকারী বিমান বাহিনী প্রধান (প্রশাসন) এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধার কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন। সেনা প্রধান, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে গিয়েছেন।
এই ঘটনা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ইতিহাসে একটি বিরল ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা বলে বিবেচিত হচ্ছে। সাধারণত যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ এলাকা বা খোলা জায়গায় ঘটে থাকে, কিন্তু এবার সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হওয়ায় এত বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। গত ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মোট ৩২টি বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, তবে এর মধ্যে উত্তরার এই ঘটনা সবচেয়ে মর্মান্তিক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফ-৷ ধরনের যুদ্ধবিমানে এর আগেও কয়েকবার যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট তাহমিদ রুম্মান নিখোঁজ হন। সাধারণত প্রশিক্ষণ বিমানে এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে, বিশেষ করে পিটি-৬, ইয়াক-১৩০, এল-৩৯ বা এফ-৭ ধরনের বিমানে।
উদ্ধারকারী দলগুলো রাত পর্যন্ত কাজ চালিয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল সাংবাদিকদের জানান যে, ১৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এবং ৮৩ জন আহতকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যাদের মৃতদেহ শনাক্ত করা যায়নি, তাদের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রেলপথের রক্তাক্ত অধ্যায়: ভারতের পাঁচটি মর্মান্তিক ট্রেন বিপর্যয়
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা বর্ণনা করেন যে, বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠেছিল। বিমানটি স্কুলের ক্যান্টিনের ছাদে আঘাত করার পর তাৎক্ষণিক আগুন লেগে যায়। সেনা সদস্যরা আহত শিক্ষার্থীদের কোলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে দেখা গেছে। দমকল বিভাগের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করেছে এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা জানিয়েছেন যে, এই দুর্ঘটনার ‘ভালো রকমের তদন্ত’ করা হবে। তদন্ত কমিটি যান্ত্রিক ত্রুটির সুনির্দিষ্ট কারণ, বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ পরিস্থিতি এবং পাইলটের প্রশিক্ষণ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাবে। বিমান বাহিনী জানিয়েছে যে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবশেষে, এই মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা বাংলাদেশের সামরিক বিমান চালনার ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। যদিও প্রাথমিক তদন্তে যান্ত্রিক ত্রুটিই দুর্ঘটনার কারণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, তবুও বিস্তারিত তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাবে। পাইলটের আত্মত্যাগমূলক প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি আরও বড় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারেননি। নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।