ঘুমানোর সঠিক নিয়ম কোনটি? বাম, ডান, চিত, নাকি উপুড়!

Best sleeping position for health: আমরা প্রত্যেকেই প্রতিদিন আমাদের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে কাটাই। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে কীভাবে ঘুমালে আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে? শুধু ঘুমের পরিমাণই নয়, ঘুমের ভঙ্গিও আমাদের স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। চিত হয়ে, উপুড় হয়ে, নাকি পাশ ফিরে – কোন পদ্ধতিতে ঘুমালে আমাদের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে অনেক রোগ-ব্যাধি থেকে দূরে থাকা সম্ভব। আজকের এই আলোচনায় আমরা জানব ঘুমানোর সঠিক নিয়ম এবং বিভিন্ন শয়নভঙ্গির উপকারিতা সম্পর্কে।

ঘুমের গুরুত্ব এবং শয়নভঙ্গির প্রভাব

আমরা জানি, সুস্থতার জন্য ঘুম কত জরুরি। ঠিকঠাক ঘুমানোর জন্য অনেকগুলো বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়3। ভালো ঘুম ভালো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন ঘুমাচ্ছেন, আপনার শরীর বিভিন্ন কাজ করতে থাকে। শিশু থেকে শুরু করে কিশোর বয়সে বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন।

আপনি যেভাবেই ঘুমান না কেন, ঘুমের অবস্থান আপনার খাবার হজমকে প্রভাবিত করে। আপনি যখন ঘুমাচ্ছেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক এবং শরীর সারাদিন ধরে খাওয়া খাবার এবং পানীয় হজম করার জন্য কাজ করে1। ঘুমের অভাব উল্লেখযোগ্যভাবে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

আমেরিকার মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির স্লিপ ল্যাবের পরিচালক জেনিফার এমডি বলেন, “ব্যক্তির জীবনের পর্যায়ভেদে আর অসুস্থতার ওপর নির্ভর করে তাঁর আদর্শ শয়নভঙ্গি”।

চিত হয়ে শোয়া: স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নাকি ক্ষতিকর?

বিভিন্ন শয়নভঙ্গি ও তার উপকারিতা (Different Sleeping Positions and Benefits)

কেউ কেউ রাতে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমাতে বেশি পছন্দ করেন, আবার কেউ কেউ চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু রাতের পরিপূর্ণ বিশ্রামের জন্য কোন অবস্থায় ঘুমালে তা স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো?2 আসুন দেখে নেই বিভিন্ন শয়নভঙ্গির উপকারিতা:

বাম পাশে ঘুমানোর উপকারিতা

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাম কাত হয়ে শোয়ার অভ্যাস করা ভালো5। ‘দ্য স্লিপ ডক্টরস ডায়েট প্ল্যান’ বইয়ের লেখক ডা. মাইকেল ব্রুস জানান, এভাবে ঘুমানোর অভ্যাস শরীরে রক্ত চলাচলকে সচল রাখতে ভালো কাজ করে এবং ঘুম ভেঙে আপনি বেশ ফুরফুরে অনুভব করবেন।

বাম পাশে ঘুমানোর উল্লেখযোগ্য উপকারিতাগুলি:

• জটিল রোগ প্রতিরোধ করবে: বাম কাত হয়ে ঘুমালে শরীর থেকে লিম্পেথেটিক ড্রেনেজের (লসিকানালি) মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থ বা টক্সিন দূর হয়।

• কিডনি ও লিভারের কার্যক্রম: লিভার ও কিডনি শরীরের খুব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এভাবে শোয়া কিডনি ও লিভারে জমাকৃত বর্জ্য পদার্থ সহজে বের করে দিতে সাহায্য করে।

• হজমে সাহায্য করে: বাম কাত হয়ে ঘুমালে পাকস্থলি ও প্যানক্রিয়াস স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে। এটা খাবারকে হজম করতে সাহায্য করে।

• বাউয়েল মুভমেন্ট: আমরা যখন বাম কাত হয়ে ঘুমাই তখন মধ্যাকর্ষণের কারণে খাবার ক্ষুদ্রান্ত থেকে বৃহদন্তে সহজে যেতে পারে। ফলে সকালবেলা ভালোভাবে মলত্যাগ হতে সাহায্য করে।

• হার্টকে ভালো রাখে: বাম কাত হয়ে ঘুমালে হার্টের কাজের চাপ কমে। হার্টে রক্ত চলাচল ভালো হয়।

• এসিডিটি ও বুক জ্বালাপোড়া দূর করে: বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাম কাত হয়ে শোয়া এসিডিটি হতে দেয় না। এটি বুক জ্বালাপোড়াও রোধ করে।

• ক্লান্তি কাটায়: বাম কাত হয়ে ঘুমালে গলব্লাডার এবং লিভার স্বাভাবিকভাবে ঝুলে থাকে। হজম শক্তি কম খরচ হয়। তাই এটা সকালের ক্লান্তি কাটায়।

• চর্বিযুক্ত লিভার প্রতিরোধে সাহায্য করে: লিভার এবং গলব্লাডার থেকে এক প্রকার রস নিঃসরণ হয়। এটি চর্বিকে ইমালসিফিকেশন পদ্ধতির মাধ্যমে হজমে সাহায্য করে।

চিত হয়ে ঘুমানো

ঘুমের বিশেষ সমস্যা না থাকলে আর গর্ভবতী না হলে চিত হয়ে ঘুমাতে আপত্তি নেই। বরং যাঁদের ব্যাকপেইন বা শিরদাঁড়ার সমস্যা আছে, তাঁরা চিত হয়ে শুলেই ভালো3। এতে তাঁরা আরাম পাবেন। কারণ, এভাবে ঘুমালে শিরদাঁড়া যথাস্থানে থাকে।

চিত হয়ে ঘুমানোর সুবিধা ও অসুবিধা:

• সুবিধা:

  • যাঁদের অ্যাসিড রেফ্লাক্স হয় অর্থাৎ অম্লরস পাকস্থলী থেকে ওপরে উঠে আসে, তাঁদের জন্য চিত হয়ে শোয়াই ভালো।

  • যাঁদের সাইনাস সমস্যা আছে, তাঁদের শিয়র উঁচু করে শোয়াই ভালো।

• অসুবিধা:

  • লোয়ার ব্যাকপেইন থাকলে চিত হয়ে শুলে ব্যথা বেড়ে যায়।

  • আপনি যদি আপনার পিঠের উপর ভর দিয়ে ঘুমান, তবে এই অবস্থানটি ঘুমের জন্য সঠিক বলে মনে করা হয় না।

  • আপনার যদি বুক জ্বালা এবং অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকে, তবে এভাবে ঘুমালে আপনার সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে1।

  • এই অবস্থায় ঘুমালে আপনার অ্যাসিড হতে পারে, যার কারণে আপনি গলায় জ্বালাপোড়া অনুভব করতে পারেন।

  • আপনার যদি স্লিপ অ্যাপনিয়া হয়, তাহলে পিঠের ওপর ভর দিয়ে ঘুমালে আপনার সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।

উপুড় হয়ে ঘুমানো

যাঁদের শ্বাসের সমস্যা, নাকডাকার সমস্যা আছে, তাঁদের উপুড় হয়ে শোয়াই ভালো3। করোনা অতিমারিতে যাঁদের শ্বাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে, অক্সিজেন কমে যাওয়া ঠেকাতে তাঁদের এমন উপুড় হয়ে শোয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

তবে সতর্কতা:

• যাঁদের মাথা ধরা বা ঘাড়ব্যথার প্রবণতা আছে, তাঁদের জন্য এ ভঙ্গি ভালো নয়।

• যাঁরা উপুড় হয়ে শুতে পছন্দ করেন, তাঁরা নরম পাতলা বালিশে শোবেন।

পাশ ফিরে ঘুমানো

যাদের বুক জ্বালা, অ্যাসিডিটি এবং গ্যাসের সমস্যা আছে, তাদের জন্য এক পাশ ফিরে ঘুম খুবই উপকারী। পাশ ফিরে ঘুমানোর ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা বাম পাশকে অধিক গুরুত্ব দেন।

বিশেষ অবস্থার জন্য শয়নভঙ্গির নিয়ম (Sleeping Rules for Special Conditions)

গর্ভাবস্থায় ঘুমানোর সঠিক নিয়ম

গর্ভাবস্থায় বুক জ্বালা বেশ সাধারণ। আপনি যদি গর্ভবতী হোন এবং বাম দিকে ঘুমান তবে এটি রক্ত প্রবাহ এবং কিডনির কার্যকারিতা ভাল করে। গর্ভবতী নারীদের কাত হয়ে শোয়া ভালো। এতে রক্ত চলাচল ভালো হয়। চিত হয়ে ঘুমালে পেটের ভেতরের শিরায় চাপ পড়ে। এতে রক্তের প্রবাহ বাধা পায়।

স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীদের জন্য

স্লিপ অ্যাপনিয়ায়, ঘুমানোর সময় একজন ব্যক্তির শ্বাস বারবার বন্ধ হয়ে যায় এবং নড়াচড়া করে। যাঁদের আছে অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, তাঁদের পাশ ফিরে শোয়া ভালো। তাতে এ ধরনের মানুষের শ্বাসপথ খোলা থাকে। চিত হয়ে ঘুমালে জিবের ওপর অভিকর্ষ টান পড়ে, এতে শ্বাসপথ রোধ হয়ে যায়। তাই পাশ ফিরে ঘুমালে শ্বাসপথ অবরুদ্ধ থাকলেও আংশিক খুলে যায়।

ব্যাকপেইন থাকলে

লোয়ার ব্যাকপেইন থাকলে চিত হয়ে শুলে ব্যথা বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে হাঁটুর নিচে বালিশ দিলে পা নিচ দিকে টানবে না।

ঘুমানোর আদর্শ সময় (Ideal Sleeping Time)

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালে এই সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি রাতে ১০ টার মধ্যে ঘুমানো উচিত। এই গবেষণাটি করা হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে রাত ১০টা পর্যন্ত ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের শরীরের একটি অভ্যন্তরীণ ঘড়ি রয়েছে, যাকে সার্কাডিয়ান রিদম বলে। এই ঘড়িটি আমাদের শরীরের ঘুম থেকে জেগে ওঠা থেকে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত সঠিক সময় নির্দেশ করে। সার্কাডিয়ান রিদমও আপনার ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্য ডোবার পরে অন্ধকার হয়ে যায় এবং এই সময়ে সার্কাডিয়ান রিদম আপনার মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় যে এটি ঘুমানোর সময়।

ঘুম ও হজম প্রক্রিয়া (Sleep and Digestion Process)

খাবার খেয়ে ঘুমালে আপনার হজম প্রক্রিয়া খুব ধীর হয়ে যায়। ঘুমানোর পর, আমাদের পরিপাকতন্ত্র খাবার হজম করতে ৩০ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় নেয়। আপনি কী খাচ্ছেন, পান করছেন এবং আপনার মেটাবলিজম কেমন হচ্ছে তার উপরও ডায়েটের সময় নির্ভর করে।

নিম্নলিখিত জিনিসগুলি আপনার ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে:

• ঘুমানোর কিছুক্ষণ আগে খাওয়া

• অতিরিক্ত খাওয়া

• মশলাযুক্ত খাবার খাওয়া

• অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন সেবন

• উচ্চ শর্করাযুক্ত খাবার

ঘুমের মান উন্নত করার উপায় (Ways to Improve Sleep Quality)

ভালো ঘুমের জন্য শুধু সঠিক শয়নভঙ্গি নয়, অন্যান্য বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে:

1. নিয়মিত সময়ে ঘুমানো: প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা আপনার শরীরের সার্কাডিয়ান রিদমকে সাহায্য করে।

2. ঘুমানোর কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা আগে খাওয়া বন্ধ করা: ঘুমানোর আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। এতে হজম প্রক্রিয়া ও ঘুমের মান উন্নত হয়।

3. সঠিক বালিশ ব্যবহার করা: ঘুমালে শ্বাসপ্রশ্বাসে যাঁদের সমস্যা হয়, তাঁদের বেছে নিতে হবে পুরু বালিশ, যাতে পাশ ফিরে ঘুমালে মাথা নিচে নেমে না আসে।

4. ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা: ঘুমানোর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইস (ফোন, ট্যাবলেট, টিভি) থেকে দূরে থাকুন।

5. শান্ত পরিবেশ তৈরি করা: ঘুমানোর জন্য শান্ত, অন্ধকার, এবং শীতল পরিবেশ তৈরি করুন।

ঘুমানোর আগে মন্ত্র: শান্তিপূর্ণ নিদ্রার জন্য প্রাচীন প্রজ্ঞা

ঘুমের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ (Disease Prevention Through Sleep)

সঠিক শয়নভঙ্গি এবং ঘুমের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব:

• হৃদরোগ প্রতিরোধ: বাম কাত হয়ে ঘুমালে হার্টের কাজের চাপ কমে। হার্টে রক্ত চলাচল ভালো হয।

• হজম সমস্যা দূরীকরণ: সঠিক শয়নভঙ্গি দ্বারা খাবার হজমে সাহায্য করা সম্ভব, যা এসিডিটি, অম্বল ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে।

• লিভার ও কিডনি রোগ প্রতিরোধ: বাম পাশে ঘুমালে লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা বাড়ে, যা এই অঙ্গগুলোর রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

• মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি: ভালো ঘুম মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে, যা স্ট্রেস ও উদ্বেগ কমাতে সহায়তা করে।

ঘুমানোর সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে আমরা অনেক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে পারি। বাম পাশে ঘুমানো সাধারণত সবচেয়ে উপকারী, বিশেষ করে হজম, রক্ত চলাচল এবং টক্সিন বের করার জন্য। তবে, প্রত্যেক ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা ভিন্ন হওয়ায় তার উপযোগী শয়নভঙ্গি নির্বাচন করা প্রয়োজন।

রাত ১০টার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া, নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো, এবং ঘুমের আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলা সবার জন্য উপকারী। যদি ঘুমের বিশেষ সমস্যা (স্লিপ অ্যাপনিয়া, ইনসোমনিয়া) থাকে, একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।সঠিক ঘুমের নিয়ম মেনে চললে আমরা সুস্থ, সতেজ ও দীর্ঘজীবী হতে পারব – এটাই আমাদের সবার কাম্য।