When is Muharram 2025: ইসলামি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহরম আসছে আর মাত্র কয়েকদিন পরেই। ২০২৫ সালে ভারতে মহরম পালিত হবে ৬ জুলাই, রবিবার। চাঁদ দেখা কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ২৬ জুন শুক্রবার ভারতে চাঁদ দেখা গেছে এবং ২৭ জুন থেকে নতুন ইসলামিক বছর শুরু হয়েছে। মহরমের দশম দিন, যা আশুরা নামে পরিচিত, সেই দিনই এই পবিত্র অনুষ্ঠান পালিত হবে।
মহরম শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতি বহন করে। কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ এবং সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাঁর লড়াইয়ের কাহিনী আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে।
মহরম কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
“মহরম” শব্দের অর্থ সম্মানিত বা পবিত্র। এটি ইসলামিক হিজরি সনের প্রথম মাস এবং চারটি পবিত্র মাসের অন্যতম, যেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্য তিনটি পবিত্র মাস হলো রজব, জিলকদ এবং জিলহজ।
হাদিস শরিফে মহরম মাসকে “শাহরুল্লাহ” বা “আল্লাহর মাস” বলা হয়েছে। এই বিশেষ অভিধান থেকেই বোঝা যায় এই মাসের কতটা গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে: “আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২, এর মধ্যে ৪টি মাস সম্মানিত”।
আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
প্রাচীন ইতিহাসে আশুরা
মহরমের দশম দিন আশুরা কেবল কারবালার ঘটনার জন্যই বিখ্যাত নয়। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। এই দিনেই:
- হযরত আদম (আ.) এর তওবা কবুল হয়
- হযরত নূহ (আ.) এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থামে
- হযরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পান
- হযরত মুসা (আ.) এবং বনি ইসরাইল ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পায়
- হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান
ইহুদি সম্প্রদায়ের আশুরা পালন
মহানবী (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি দেখেন যে ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এই দিনে হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আমরা মুসার অধিক নিকটবর্তী, তোমরা ইহুদিদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য আশুরার এক দিন আগে বা পরে রোজা রাখো”।
কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস
ঘটনার পটভূমি
৬৮০ খ্রিস্টাব্দে (৬১ হিজরি) ইসলামের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় রচিত হয়10। তৎকালীন উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ক্ষমতায় আসার পর, তিনি ইমাম হুসাইনের কাছে বায়আত (আনুগত্যের শপথ) দাবি করেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন, যিনি ছিলেন মহানবী (সা.) এর দৌহিত্র এবং হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমা (রা.) এর পুত্র, তিনি ইয়াজিদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
কারবালার যুদ্ধ
কুফাবাসীদের আমন্ত্রণে ইমাম হুসাইন তাঁর পরিবার ও ৭২ জন সাথীসহ কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু পথিমধ্যে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদের বিশাল সেনাবাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে।
১০ মহরম (১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হয়। একের পর এক ইমাম হুসাইনের সাথীরা শহিদ হতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন একাই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করেন এবং শাহাদাত বরণ করেন। এই যুদ্ধে তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্রায় সবাই শহিদ হন।
বাংলায় মহরম উদযাপনের ঐতিহ্য
ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলায় মহরম উদযাপনের ইতিহাস কয়েকশো বছরের পুরাতন। মুঘল আমলে বাংলার শাসকশ্রেণী শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় এই অঞ্চলে মহরম পালনের বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ষোড়শ শতকে রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুমের মাজার প্রাঙ্গণে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে মহরম উদযাপিত হতো।
পুরান ঢাকার মহরম
পুরান ঢাকায় মহরম উদযাপনের রয়েছে এক বিশেষ ঐতিহ্য। প্রথম দশ দিন জুড়ে চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান:
- প্রথম তিন দিন হোসেনী দালানের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো হয়
- চতুর্থ দিন মর্সিয়া গানের আসর বসে
- পঞ্চম দিন বিশেষ পোশাকে মিছিল
- দশম দিন তাজিয়া মিছিল নিয়ে আজিমপুরে সমাবেশ
মহরমের ধর্মীয় তাৎপর্য ও আমল
রোজার গুরুত্ব
আশুরার দিন রোজা রাখা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি আশাবাদী, তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন”। তবে উত্তম হলো আশুরার সাথে ৯ অথবা ১১ তারিখেও রোজা রাখা।
দান-খয়রাত ও দোয়া
এই দিনে বেশি বেশি দান-খয়রাত করা এবং পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা সুন্নত। হাদিসে এসেছে: “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, আল্লাহ সারা বছর তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন”।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মহরম পালন
সুন্নি মুসলমানদের মহরম
সুন্নি মুসলমানরা মূলত আশুরার দিনকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন হিসেবে পালন করেন। তারা এই দিনে রোজা রাখেন, বিশেষ নামাজ পড়েন এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন বিভিন্ন নবী-রাসুলদের মুক্তির জন্য।
শিয়া মুসলমানদের মহরম
শিয়া মুসলমানরা এই দিনটিকে শোকের দিন হিসেবে পালন করেন। তারা ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের স্মৃতিচারণ করেন, মর্সিয়া পাঠ করেন এবং তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করেন। অনেক শিয়া মুসলমান এই দিনে মাতম করেন এবং শোক প্রকাশ করেন।
মহরমের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
সামাজিক ন্যায়বিচার
আজকের যুগে মহরমের বার্তা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ আমাদের শেখায় যে, অন্যায় শাসকের সামনে মাথা না নুইয়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। এই বার্তা আজকের সমাজে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব
মহরম সকল মুসলমানের জন্য একটি ঐক্যের বার্তা নিয়ে আসে। সুন্নি-শিয়া নির্বিশেষে সকলেই এই দিনের গুরুত্ব স্বীকার করেন। এটি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
মহরম শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি মানবতার এক অনন্য শিক্ষা। ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগ আমাদের শেখায় যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এ বছর ৬ জুলাই যখন আমরা মহরম পালন করব, তখন আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে এই দিনটি শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, বরং আমাদের জীবনে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অটুট অঙ্গীকার প্রকাশের জন্য।মহরমের এই পবিত্র দিনে আমরা সকলে মিলে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিই। ইমাম হুসাইনের আদর্শ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলি।