Days to avoid plucking bel leaves: হিন্দু ধর্মে বেল বা বিল্বপত্র ছাড়া শিবের আরাধনা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। এই পবিত্র পত্রের প্রতিটি অংশেই দেবাদিদেব মহাদেবের বাস। তবে, শিবের প্রিয় এই পাতা যখন তখন গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা উচিত নয়। শাস্ত্র অনুসারে, নির্দিষ্ট কিছু তিথি ও দিনে বেলপাতা তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সঠিক নিয়ম না মেনে বেলপাতা তুললে তা শিবপূজায় গ্রহণীয় হয় না এবং এর ফলে পূজার পূর্ণ ফল লাভ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। তাই, সকল শিবভক্তের জেনে রাখা উচিত বেলপাতা কবে তুলতে নেই এবং এর সঠিক নিয়মাবলী কী। মূলত, সোমবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, সংক্রান্তি, অষ্টমী এবং চতুর্দশী তিথিতে বেলপাতা তোলা শাস্ত্রমতে নিষিদ্ধ। এই দিনগুলিতে পূজার প্রয়োজনে আগের দিন তুলে রাখা বেলপাতা ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ বেলপাতা কখনও বাসি বা উচ্ছিষ্ট হয় না।
সাধারণত, শিবপূজার অন্যতম প্রধান উপাদান হল বেলপাতা। স্কন্দপুরাণ অনুসারে, বেল গাছের মূলে স্বয়ং মহাদেব বাস করেন এবং এই গাছের প্রতিটি অংশে বিভিন্ন দেবদেবীর অধিষ্ঠান। শিব পুরাণ অনুযায়ী, তিনটি পাতাযুক্ত বেলপত্রকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটি মহাদেবের ত্রিশূলেরও প্রতীক। এর তিনটি পাতা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণেরও পরিচায়ক। এই কারণেই শিবের পূজায় বেলপাতার এত গুরুত্ব। কিন্তু এই পবিত্র পাতা চয়নের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক। ভুল দিনে বা ভুল পদ্ধতিতে বেলপাতা তুললে পূজারী পাপের ভাগী হতে পারেন বলে শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।
বেলপাতা চয়নের নিষিদ্ধ দিন ও তিথি
হিন্দু শাস্ত্র এবং বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে, সপ্তাহের বিশেষ দিন এবং চান্দ্র মাসের নির্দিষ্ট তিথিতে বেলপাতা গাছ থেকে ছেঁড়া উচিত নয়। এই নিয়মগুলি প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং বৃক্ষ সংরক্ষণের এক আধ্যাত্মিক উপায়ও বটে। আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক কোন কোন দিন বেলপাতা তোলা নিষিদ্ধ।
সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন: সোমবার
সোমবার দিনটি দেবাদিদেব মহাদেবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এই দিনে শিবের পূজা করলে অশেষ পুণ্য লাভ হয়। যেহেতু এই দিনটি শিবের অত্যন্ত প্রিয়, তাই সোমবার বেল গাছকে আঘাত করা বা তার পাতা ছেঁড়া অনুচিত বলে মনে করা হয়। ভক্তদের উচিত, পূজার প্রয়োজনে রবিবার বা তার আগের দিন বেলপাতা তুলে রাখা।
চান্দ্র মাসের বিশেষ তিথি
তিথি হিন্দুদের কাল গণনার এক গুরুত্বপূর্ণ একক। নির্দিষ্ট কিছু তিথিতে বেলপাতা তোলা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে:
- চতুর্থী তিথি: এই তিথিতে বেলপাতা তোলা উচিত নয়।
- অষ্টমী তিথি: দুর্গাপূজা বা অন্যান্য বিশেষ পূজার অষ্টমী তিথিতেও বেলপাতা চয়ন করা নিষিদ্ধ।
- চতুর্দশী তিথি: শিবরাত্রির দিনটি কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পড়ে। এই তিথি শিবের জন্য অত্যন্ত বিশেষ হওয়ায় এদিন বেলপাতা তোলা হয় না। সাধারণত, শিবরাত্রির পূজার জন্য আগের দিনই বেলপাতা সংগ্রহ করে রাখা হয়।
- অমাবস্যা তিথি: অমাবস্যার দিনে প্রকৃতিতে নেতিবাচক শক্তির প্রভাব বেশি থাকে বলে মনে করা হয়। এই দিনে বেলপাতা সহ অন্যান্য পবিত্র গাছের পাতা ছেঁড়া অশুভ।
- পূর্ণিমা তিথি: পূর্ণিমার দিনেও বেলপাতা চয়ন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
সংক্রান্তি
যখন সূর্য এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করে, সেই সময়কে সংক্রান্তি বলা হয়। মকর সংক্রান্তি, কর্কট সংক্রান্তি ইত্যাদি বিভিন্ন সংক্রান্তির দিনে বেলপাতা তোলা নিষিদ্ধ। এই সময়টিকে আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় এবং বৃক্ষ ছেদন বা পাতা ছেঁড়ার মতো কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
এই নির্দিষ্ট দিনগুলিতে বেলপাতা তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণ হল, এই সময়গুলিতে গাছেদের বিশ্রামকাল বলে মনে করা হয় এবং তাদের উপর আঘাত হানলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই নিয়মগুলি প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বেলপাতা তোলার সঠিক নিয়ম ও মন্ত্র
বেলপাতা কেবল সঠিক দিনেই নয়, সঠিক পদ্ধতিতেও চয়ন করা উচিত। নিয়ম না মেনে পাতা তুললে তা পূজার অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে।
১. স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে বেলপাতা তুলুন:
বেলপাতা তোলার আগে স্নান করে পরিষ্কার ও শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করা আবশ্যক। অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় বেলপাতা স্পর্শ করা উচিত নয়।
২. বৃক্ষকে প্রণাম ও অনুমতি গ্রহণ:
গাছের কাছে গিয়ে প্রথমে হাতজোড় করে প্রণাম করতে হবে। এরপর মনে মনে বা উচ্চারণ করে বিল্ববৃক্ষের কাছে পাতা চয়নের জন্য অনুমতি চাইতে হবে। এটি প্রকৃতির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধার প্রকাশ।
৩. একটি একটি করে পাতা চয়ন:
বেলপাতা তোলার সময় ডাল ধরে ঝাঁকানো একদমই উচিত নয়। এর ফলে গাছের ক্ষতি হয় এবং কচি পাতা ও ডাল ভেঙে যেতে পারে। একটি একটি করে সাবধানে পাতা ছিঁড়ে নিতে হবে, যাতে গাছের কোনো ক্ষতি না হয়।
৪. বেলপাতা তোলার মন্ত্র:
বেলপাতা তোলার সময় একটি বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করার বিধান রয়েছে। এই মন্ত্র উচ্চারণ করলে বিল্বপত্র চয়নের জন্য বৃক্ষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। মন্ত্রটি হল:
“নমো বিল্ববৃক্ষায় ব্রহ্মরূপিণে। নমো দেবপ্রিয়ায় শিবরূপিণে।।”
এবং পাতা তোলার সময় এই মন্ত্রটিও পাঠ করা হয়:
“অমৃতোদ্ভব শ্রীফল ছিন্ন ভিন্নং করোমি চেৎ। বিল্বপত্র হর ত্বঞ্চ মমাজ্ঞানং ক্ষমস্ব তৎ।।”
এর অর্থ হল, “হে অমৃত থেকে জাত শ্রীফল, আমি আপনার পত্র ছিন্ন করছি। হে বিল্বপত্র, আমার এই অজ্ঞানতাকে ক্ষমা করুন।”
৫. ছেঁড়া বা পোকায় খাওয়া পাতা বর্জন:
পূজার জন্য সর্বদা পরিষ্কার, অক্ষত এবং তিনটি পাতাযুক্ত বেলপত্রই চয়ন করা উচিত। কোনো ছেঁড়া, ফাটা, শুকনো বা পোকায় খাওয়া পাতা পূজার জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়। বেলপত্রে কোনো চক্র বা দাগ থাকলেও তা ব্যবহার করা উচিত নয়।
৬. সূর্যাস্তের পরে বেলপাতা তুলবেন না:
শাস্ত্র মতে, সূর্যাস্তের পরে কোনো গাছের পাতা ছেঁড়া উচিত নয়। তাই দিনের বেলাতেই বেলপাতা সংগ্রহ করে নেওয়া শ্রেয়।
বেলপাতার গুরুত্ব ও উপকারিতা
শিবপূজায় বেলপাতার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি কেবল একটি পাতা নয়, এটি ভক্তি, সমর্পণ এবং পবিত্রতার প্রতীক।
বেলপত্রের বৈশিষ্ট্য | আধ্যাত্মিক তাৎপর্য | সূত্র |
ত্রিপত্র (তিনটি পাতা) | ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (ত্রিমূর্তি) বা শিবের ত্রিশূলের প্রতীক। | শিব পুরাণ |
ঔষধি গুণ | আয়ুর্বেদে বেলপাতা ডায়াবেটিস, হজমের সমস্যা ও ত্বকের রোগে ব্যবহৃত হয়। | NCBI গবেষণা পত্র |
শীতল প্রভাব | বেলপাতার শীতল প্রভাবের জন্য এটি শিবের মস্তকে অর্পণ করা হয়, যাতে তাঁর উগ্র স্বভাব শান্ত থাকে। | পৌরাণিক বিশ্বাস |
বাসি না হওয়া | বেলপাতা কখনও বাসি হয় না। তাই প্রয়োজনে আগের দিন তুলে রাখা পাতা দিয়েও পূজা করা যায়। | স্কন্দপুরাণ |
শিব পুরাণে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে যে, একবার এক শিকারি শিকার করতে গিয়ে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলে। রাত্রিবেলা হিংস্র জন্তুর ভয়ে সে একটি বেলগাছে আশ্রয় নেয়। সারারাত জেগে থাকার জন্য এবং শীত নিবারণের জন্য সে গাছের পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকে। সেই গাছের নিচেই ছিল একটি শিবলিঙ্গ। শিকারির অজান্তেই তার ফেলা বেলপাতা শিবলিঙ্গের উপর পড়তে থাকে এবং তার সারারাতের উপবাস ও জাগরণ শিবরাত্রির ব্রত পালনের সমান হয়ে যায়। এর ফলে মহাদেব তার উপর প্রসন্ন হন এবং তাকে মোক্ষ প্রদান করেন। এই কাহিনি থেকে বেলপাতার মহিমা বোঝা যায়।
পূজার জন্য কেমন বেলপাতা ব্যবহার করবেন?
পূজার জন্য বেলপাতা বাছাই করার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি:
- বেলপাতা যেন তিনটি পাতার সমন্বয়ে একটি পূর্ণ পত্র হয়।
- পাতাগুলি যেন কোনোভাবে খণ্ডিত, শুকনো বা বিকৃত না হয়।
- অনেক সময় বেল গাছে পাঁচ বা সাত পাতার বেলপত্রও দেখা যায়, যা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
- বেলপাতার মসৃণ দিকটি শিবলিঙ্গের উপর স্পর্শ করিয়ে অর্পণ করতে হয়।
- বেলপাতা অর্পণের সময় ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ মন্ত্র জপ করা উচিত।
যদি নিষিদ্ধ দিনে বেলপাতার প্রয়োজন হয়?
যদি সোমবার বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ তিথিতে শিবপূজার জন্য বেলপাতার প্রয়োজন হয়, তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। বেলপাতা একমাত্র পূজা সামগ্রী যা কখনও বাসি বা উচ্ছিষ্ট হয় না। তাই আগের দিন তুলে রাখা পাতা দিয়েই পূজা সম্পন্ন করা যায়। এমনকি, শিবলিঙ্গ থেকে বেলপাতা তুলে নিয়ে তা জল দিয়ে শুদ্ধ করে পুনরায় অর্পণ করা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং বিভিন্ন গবেষণায় বেলের ঔষধি গুণের কথা স্বীকার করা হয়েছে, যা এর পবিত্রতার ধারণাকে আরও দৃঢ় করে।
সুতরাং, মহাদেবের কৃপা লাভের জন্য বেলপাতা অর্পণের সময় এই শাস্ত্রীয় নিয়মগুলি মেনে চলা একান্তই আবশ্যক। এটি কেবল আমাদের পূজাকেই সার্থক করে তোলে না, বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতেও শেখায়। এই নিয়মগুলি পালন করার মাধ্যমে আমরা আধ্যাত্মিক এবং প্রাকৃতিক উভয় জগতেই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি।