শিশুর খাবারে লবণ-চিনি কখন দেবেন? জানুন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

Debolina Roy 6 Min Read

when safe add salt sugar baby food: নতুন মা-বাবারা প্রায়ই দ্বিধায় থাকেন যে তাদের শিশুর খাবারে লবণ-চিনি কবে থেকে দেওয়া শুরু করবেন। এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভুল সময়ে এই উপাদানগুলো দেওয়া শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ভারতীয় শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর প্রথম বছরে লবণ ও চিনি একেবারেই এড়িয়ে চলা উচিত। আজকের এই লেখায় আমরা জানব কেন এই নিষেধাজ্ঞা, কখন থেকে নিরাপদে এগুলো দেওয়া যায় এবং কীভাবে শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়।

কেন শিশুর খাবারে লবণ-চিনি এড়িয়ে চলবেন?

শিশুর প্রথম জীবনে লবণ ও চিনি এড়ানোর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুরা মায়ের দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক থেকেই প্রয়োজনীয় সোডিয়াম পেয়ে থাকে। শিশুর কিডনি এই সময় অপরিপক্ব থাকে এবং অতিরিক্ত লবণ প্রক্রিয়া করতে পারে না।

অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে শিশুর কিডনির কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদের কিডনি রক্ত থেকে উচ্চমাত্রার লবণ প্রক্রিয়া ও অপসারণ করতে অক্ষম। এতে কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তী জীবনে কিডনি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। লবণের কারণে শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বেশি নিঃসরণ হয়, যা কিডনি স্টোনের কারণ হতে পারে।

চিনির ক্ষেত্রেও একই রকম সমস্যা। তাড়াতাড়ি চিনি দেওয়া শুরু করলে শিশুর মিষ্টি খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। এতে স্থূলতা, দাঁতের ক্ষয় এবং পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

শিশুর খাবারে লবণ কখন থেকে দেবেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর এক বছর বয়স পর্যন্ত কোনো অতিরিক্ত লবণ দেওয়া উচিত নয়। ছয় মাস বয়সের আগে শিশুরা মায়ের দুধ বা ফর্মুলা থেকেই প্রয়োজনীয় সোডিয়াম পায়। সাত থেকে বারো মাস বয়সী শিশুরা মায়ের দুধ বা ফর্মুলা এবং প্রাকৃতিক খাবারে থাকা সোডিয়াম থেকেই তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে।

এক বছর বয়সের পর যদি লবণ দিতে চান, তাহলে দিনে ১ গ্রামের কম লবণ দিন। ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ১-৩ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দৈনিক ১১০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম অর্থাৎ প্রায় আধা চা চামচ লবণ নিরাপদ বলে মনে করে। আমেরিকার সুপারিশ অনুযায়ী একই বয়সের শিশুদের জন্য দৈনিক ৮০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম বা প্রায় ০.৪ চা চামচ লবণ উপযুক্ত।

লবণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা:

  • প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন

  • ঘরে তৈরি খাবারে প্রাকৃতিক স্বাদের জন্য হার্বস ও মশলা ব্যবহার করুন

  • চাল, গমের আটা এবং পাস্তা রান্না করার সময় লবণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই

চিনি কখন থেকে দেওয়া নিরাপদ?

চিনির ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা এক বছর বয়স পর্যন্ত কোনো অতিরিক্ত চিনি না দেওয়ার পরামর্শ দেন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের একেবারেই চিনি না দেওয়ার সুপারিশ করে।

ভারতীয় মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল-ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশনের জাতীয় খাদ্য নির্দেশিকা অনুযায়ী গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী মহিলা এবং শিশুদের চিনি ও চিনির বিকল্প এড়িয়ে চলা উচিত।

চিনির পরিবর্তে কী দেবেন:

  • প্রাকৃতিক মিষ্টতার জন্য ফলের পিউরি ব্যবহার করুন

  • খেজুরের সিরাপ অল্প পরিমাণে দিতে পারেন

  • ফলের রস দিলে পানি দিয়ে পাতলা করুন

ভারতীয় শিশুদের ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থা

ভারতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৪০ শতাংশ অভিভাবক তাদের শিশুর ১২ মাস বয়স হওয়ার আগেই লবণ, চিনি বা গরুর দুধ দিয়ে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের একটি গবেষণায় দেখা গেছে ৯১.৫ শতাংশ শিশুর খাবারে তাড়াতাড়ি লবণ যোগ করা হয়।

এই প্রবণতা উদ্বেগজনক কারণ তাড়াতাড়ি লবণ গ্রহণকারী শিশুদের পরবর্তী জীবনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে যেসব শিশুর খাবারে লবণ যোগ করা হয়েছিল তাদের ওজন কম ছিল যারা লবণ পায়নি তাদের তুলনায়।

বাণিজ্যিক শিশু খাবারে লবণ-চিনির অবস্থা

ভারতীয় বাজারে পাওয়া ১১৪টি শিশু খাবার নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশিরভাগ খাবারেই সোডিয়ামের পরিমাণ কম ছিল। প্রায় সব শিশু খাবারে প্রতি পরিবেশনায় ১৩০ মিলিগ্রামের কম সোডিয়াম ছিল, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রায়। তবে দুটি পণ্যে ২৬০ মিলিগ্রামের বেশি সোডিয়াম পাওয়া গেছে।

চিনির ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন। ১১৪টি পণ্যের মধ্যে মাত্র ৩২টিতে মোট ক্যালরির ২০ শতাংশের কম চিনি ছিল। প্রায় ২৮ শতাংশ পণ্যে উচ্চ মাত্রার চিনি পাওয়া গেছে। প্রায় ৫১ শতাংশ পণ্যের প্রথম চারটি উপাদানের মধ্যে চিনি বা এর বিকল্প ছিল।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

ভারতীয় শিশু বিশেষজ্ঞ সমিতির নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ দেওয়া উচিত। এর পর কঠিন খাবার শুরু করার সময় ১২ মাস বয়স পর্যন্ত কোনো অতিরিক্ত চিনি দেওয়া উচিত নয়। এক বছরের পর চিনি দিলেও তা সীমিত রাখা উচিত এবং প্রাকৃতিক আকারে দেওয়া ভালো, প্রক্রিয়াজাত আকারে নয়।

বিশেষজ্ঞদের মূল পরামর্শ:

  • স্বাদ উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করুন

  • হার্বস ও মশলা দিয়ে খাবারের স্বাদ বাড়ান

  • শিশুকে প্রাকৃতিক খাবারের স্বাদে অভ্যস্ত করুন

দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য প্রভাব

তাড়াতাড়ি লবণ ও চিনি দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মারাত্মক। শৈশবে গৃহীত খাবারের অভ্যাস সারা জীবন স্থায়ী হয়। যেসব শিশু ছোটবেলায় লবণাক্ত খাবার খায় তারা বড় হয়েও লবণাক্ত খাবার পছন্দ করে।

একটি ২০২৪ সালের গবেষণায় দেখা গেছে যে শৈশবে চিনি সীমিত রাখলে পরবর্তী জীবনে ডায়াবেটিসসহ নানা দীর্ঘমেয়াদী রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। তাড়াতাড়ি চিনি দেওয়া শুরু করলে শিশুর প্রাকৃতিক মিষ্টি ও পুষ্টিকর খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায়।

নিরাপদ বিকল্প খাবার

শিশুর খাবারে স্বাদ বাড়ানোর জন্য নিরাপদ বিকল্প রয়েছে। রসুন, আদা, হলুদ, জিরা, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি পুষ্টিগুণও বৃদ্ধি করে।

ফলের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক মিষ্টতার জন্য আম, কলা, খেজুর, কিশমিশ ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো প্রাকৃতিক চিনির উৎস এবং অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদানও সরবরাহ করে।

শিশুর খাবারে লবণ-চিনি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে রাখবেন যে এই অভ্যাস তার সারা জীবনের জন্য। প্রথম বছরে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলুন এবং এর পরও অত্যন্ত সীমিত পরিমাণে দিন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আপনার শিশুর জন্য সঠিক খাদ্য পরিকল্পনা তৈরি করুন। মনে রাখবেন, আজকের সঠিক সিদ্ধান্ত আপনার শিশুর সুস্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি করবে।

Share This Article