Oldest nation in the world: আচ্ছা, কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই যে এত দেশ, এত সংস্কৃতি – এদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো কারা? কোন দেশটি কালের স্রোতে ভেসে আসা প্রাচীনতম সভ্যতার ধারক ও বাহক? যদি এই প্রশ্নগুলো তোমায় ভাবিয়ে থাকে, তাহলে আজকের লেখাটি তোমার জন্যই! চলো, ইতিহাসের ধূসর পথে হেঁটে জেনে আসি পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশগুলোর কয়েকটির কথা।
প্রাচীনত্বের সংজ্ঞা: জটিল এক ধাঁধা
“প্রাচীন” শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়, তাই না? আসলে, কোনো দেশকে প্রাচীন বলার মাপকাঠি কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে একটানা বসতি থাকলেই হল। আবার কারো মতে, প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকেও হিসাবে ধরতে হবে। এই জটিলতার কারণে, পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশ কোনটি, তা নিয়ে কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।
প্রাচীনত্বের দাবিদার: কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশ
এতগুলো দেশের মধ্যে থেকে কয়েকটা দেশকে আলাদা করে না দেখলে কি চলে? নিচে কয়েকটা দেশের কথা উল্লেখ করা হলো যারা প্রাচীনত্বের দাবি রাখে।
- ইরান (পারস্য): প্রায় ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে মানব বসতি রয়েছে। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল এই ইরান।
- চীন: প্রায় ২০৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের সভ্যতার শুরু।
- মিশর: নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা প্রায় ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে বিদ্যমান।
- গ্রীস: গ্রীক সভ্যতা ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ক্রিট দ্বীপে প্রসারিত ছিল।
- ভারত: সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা প্রায় ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
ইরান: ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী
ইরান, যা একসময় পারস্য নামে পরিচিত ছিল, নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন দেশ হিসেবে দাবি করে। প্রায় ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ইরানের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্য একে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে।
পারস্য সাম্রাজ্যের সোনালী দিন
প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য। এর বিস্তৃতি ছিল বিশাল, যা বর্তমান ইরান, ইরাক, তুরস্ক, মিশর এবং আরও অনেক অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই সাম্রাজ্যের অধীনে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য এবং স্থাপত্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল।
ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন
ইরানের সংস্কৃতিতে প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইসলামিক প্রভাবের এক চমৎকার মিশ্রণ দেখা যায়। এখানকার মসজিদ, প্রাসাদ এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলো আজও সেই সোনালী দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
চীন: প্রাচ্যের বিস্ময়
চীন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং দীর্ঘস্থায়ী সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের সভ্যতার সূচনা হয়। চীনের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছরের পুরনো।
প্রাচীন চীনের রাজবংশ
চীনের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে অনেক রাজবংশ এসেছে এবং গেছে। এদের মধ্যে শিয়া, শাং, ঝৌ, কিন এবং হান রাজবংশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রাজবংশগুলো চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রণ
প্রাচীন চীনের ঐতিহ্য আজও দেশটির সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। চীনের মহাপ্রাচীর, পোড়ামাটির সৈন্যদল এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান চীনের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
মিশর: ফারাওদের দেশ
মিশর নীল নদের তীরে গড়ে ওঠা এক প্রাচীন সভ্যতা। প্রায় ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে মানব বসতি বিদ্যমান। ফারাওদের শাসন, পিরামিড এবং মমির রহস্য মিশরকে আজও বিশ্ববাসীর কাছে আকর্ষণীয় করে রেখেছে।
পিরামিডের রহস্য
মিশরের পিরামিডগুলো প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। ফারাওদের মমি এবং তাদের ধন-সম্পদ পিরামিডের ভেতরে সুরক্ষিত রাখা হত। এই পিরামিডগুলো আজও মিশরীয়দের উন্নত স্থাপত্য এবং প্রকৌশলবিদ্যার প্রমাণ বহন করে।
প্রাচীন লিপি ও সংস্কৃতি
মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই লিপির মাধ্যমে তারা তাদের ইতিহাস, ধর্ম এবং জীবনের নানা দিক লিপিবদ্ধ করত।
গ্রীস: গণতন্ত্রের সূতিকাগার
প্রাচীন গ্রীসকে পশ্চিমা সভ্যতার সূতিকাগার বলা হয়। ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ক্রিট দ্বীপে গ্রীক সভ্যতা প্রসারিত ছিল। গ্রীক দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শিল্পকলা বিশ্বজুড়ে আজও সমাদৃত।
দর্শন ও বিজ্ঞান
প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো বিখ্যাত দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীর জন্ম হয়। তাদের চিন্তা ও দর্শন আজও আধুনিক বিশ্বকে প্রভাবিত করে।
গণতন্ত্রের জন্ম
প্রাচীন গ্রীসে গণতন্ত্রের প্রথম ধারণা পাওয়া যায়। গ্রীকরাই প্রথম নাগরিক অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ধারণা নিয়ে আসে।
ভারত: বৈচিত্র্যের দেশ
সিন্ধু নদের তীরে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতা প্রায় ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং ধর্মের বৈচিত্র্য একে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে।
সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। এখানকার নগর পরিকল্পনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো আজও archaeologists দের বিস্মিত করে।
বৈদিক যুগ
সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতে বৈদিক যুগের সূচনা হয়। এই সময়ে বেদ, উপনিষদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ রচিত হয়।
প্রাচীন দেশ নির্বাচনের মাপকাঠি
প্রাচীন দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করা হয়, যা নিচে দেওয়া হলো:
অবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি
যে দেশের সংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে, সেটি প্রাচীনত্বের দাবিদার হতে পারে।
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা
যে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছে, সেটিও প্রাচীন দেশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
প্রাচীন স্থাপত্য ও নিদর্শন
প্রাচীন স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন সেই দেশের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে।
কিছু বিতর্কিত মতামত
প্রাচীন দেশ নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কিছু বিতর্কিত মতামত রয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশকে প্রাচীনতম হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন, কারণ বিভিন্ন দেশের প্রাচীনত্বের দাবি বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কোনো দেশের প্রাচীনত্ব বিচার করার সময় তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা জরুরি। কারণ, সময়ের সাথে সাথে অনেক দেশের সীমানা, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই কোনো দেশের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটলে সেটি তার প্রাচীনত্বকে অস্বীকার করে না।
প্রাচীনত্বের নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান
এবার আসা যাক আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথায়। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে নতুন রাষ্ট্র হলেও, এর ভূমি কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে।
প্রাচীন জনপদ
প্রাচীনকালে বাংলাদেশ বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল, যেমন পুণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট ইত্যাদি। এই জনপদগুলোর নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছিল।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণ দেখা যায়। এখানকার ঐতিহ্য, শিল্পকলা এবং স্থাপত্য প্রাচীন বাংলার পরিচয় বহন করে।
প্রাচীন দেশগুলোর তালিকা (সারণী)
নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রাচীন দেশের নাম, তাদের সময়কাল এবং তাদের বিশেষত্ব উল্লেখ করা হলো:
দেশ | আনুমানিক সময়কাল | বিশেষত্ব |
---|---|---|
ইরান | ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য |
চীন | ২০৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | দীর্ঘস্থায়ী সভ্যতা, মহাপ্রাচীর ও পোড়ামাটির সৈন্যদল |
মিশর | ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | ফারাওদের দেশ, পিরামিড ও মমির রহস্য |
গ্রীস | ২৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | পশ্চিমা সভ্যতার সূতিকাগার, দর্শন, বিজ্ঞান ও গণতন্ত্রের জন্ম |
ভারত | ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ | সিন্ধু সভ্যতা, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য |
বাংলাদেশ | প্রাচীন জনপদ | প্রাচীন জনপদ (পুণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট), বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণ |
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
প্রাচীন দেশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন প্রায়ই মানুষের মনে দেখা যায়। নিচে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো দেশ কোনটি?
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো দেশ কোনটি, তা বলা কঠিন। কারণ, প্রাচীনত্বের সংজ্ঞা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে ইরান, চীন, মিশর, গ্রীস এবং ভারত প্রাচীনত্বের দাবিদার।
২. সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা কোনটি?
মেসোপটেমীয় সভ্যতাকে সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়। এটি প্রায় ৫০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে (বর্তমান ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্কের কিছু অংশ) গড়ে উঠেছিল।
৩. কোনো দেশকে প্রাচীন হিসেবে বিবেচনা করার মাপকাঠি কী?
কোনো দেশকে প্রাচীন হিসেবে বিবেচনা করার মাপকাঠিগুলো হলো: অবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা এবং প্রাচীন স্থাপত্য ও নিদর্শন।
৪. সিন্ধু সভ্যতা কত বছর পুরনো?
সিন্ধু সভ্যতা প্রায় ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৫. বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদগুলো কী কী?
বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদগুলো হলো: পুণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র ইত্যাদি।
তাহলে, “পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন দেশ কোনটি?” – এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো একটা নির্দিষ্ট দেশের নাম দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, প্রাচীনত্বের সংজ্ঞাটাই আপেক্ষিক। তবে, ইরান, চীন, মিশর, গ্রীস, ভারত – এই দেশগুলো যে মানবসভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা অনস্বীকার্য।আশা করি, এই লেখাটি পড়ে তোমরা পৃথিবীর প্রাচীন দেশগুলো সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছ। তোমাদের যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারো। আর হ্যাঁ, ইতিহাসকে জানতে ও ভালোবাসতে ভুলো না যেন!