ভারত-ব্রিটেন বাণিজ্যচুক্তিতে কে কী পাচ্ছে? চমকপ্রদ সুবিধার পূর্ণ তালিকা

India UK Trade Deal: ২০২৫ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লন্ডন সফরকালে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই বাণিজ্যচুক্তিতে উভয় দেশের জন্য রয়েছে অসংখ্য…

Chanchal Sen

 

India UK Trade Deal: ২০২৫ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লন্ডন সফরকালে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই বাণিজ্যচুক্তিতে উভয় দেশের জন্য রয়েছে অসংখ্য সুবিধা ও সুযোগ। ভারতের ৯৯% রপ্তানি পণ্য এখন যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারবে, অন্যদিকে ব্রিটিশ পণ্যের উপর ভারতে গড় শুল্ক ১৫% থেকে কমে ৩% হয়ে যাবে। এই চুক্তিটি কেবল একটি বাণিজ্যিক সমঝোতা নয়, বরং দুই অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্বের ভিত্তি।

আসুন জেনে নেওয়া যাক এই বাণিজ্যচুক্তিতে ভারত ও যুক্তরাজ্য আসলে কী কী সুবিধা পাচ্ছে এবং কীভাবে এটি উভয় দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ভারতের জন্য বাণিজ্যচুক্তিতে সুবিধাসমূহ

রপ্তানি খাতে অভূতপূর্ব সুযোগ

ভারতের জন্য এই চুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ৯৯% রপ্তানি পণ্যের জন্য যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার। এটি ভারতের রপ্তানি খাতে এক বিপ্লবী পরিবর্তন আনবে। বিশেষত টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, রত্ন ও অলঙ্কার, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ভারত বিশাল সুবিধা পাবে।

টেক্সটাইল শিল্পে তিরুপুর, সুরাট, লুধিয়ানা, পুনে, চেন্নাই, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতো প্রধান উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে রপ্তানি ২০-৪০% বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। চামড়া শিল্প দুই বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের বাজারে অতিরিক্ত ৫% অংশীদারিত্ব দখল করতে পারবে।

ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশী ইলিশের চাহিদায় ধস , দেশীয় ইলিশের জনপ্রিয়তা বেড়েছে

প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিতে উত্থান

ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ক্ষেত্রে ১,৬৫৯টি শুল্ক লাইনের সুবিধা পাবে ভারত, যা এই চুক্তির সবচেয়ে বড় ক্যাটাগরি। ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রনিক্স রপ্তানি ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি আগামী অর্থবছরে ৩০-৪০% বৃদ্ধি পেতে পারে।

কৃষি ও সামুদ্রিক পণ্যে বিশেষ সুবিধা

কৃষি খাতে ৯৫% পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে ভারত। বাসমতি চাল, মসলা, চা, সামুদ্রিক মাছ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা রয়েছে। সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানিতে ৯৯% পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে ভারত, যার মধ্যে চিংড়ি ও টুনা মাছ অন্তর্ভুক্ত।

সেবা খাতে অগ্রগতি

আইটি এবং সফটওয়্যার সেবার ক্ষেত্রে ভারত বার্ষিক ২০% প্রবৃদ্ধি আশা করতে পারে। ৩৫টি খাতে ভারতীয় পেশাদারদের জন্য দুই বছর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে কাজ করার সুবিধা রয়েছে। স্বাধীন পেশাদার, বাবুর্চি, সঙ্গীতশিল্পী, যোগ প্রশিক্ষক এবং চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা নতুন সুযোগ পাবেন।

প্রতি বছর ৬০,০০০ আইটি বিশেষজ্ঞ এই চুক্তির সুবিধা নিতে পারবেন, বিশেষত টিসিএস, ইনফোসিস, টেক মহিন্দ্রা, এইচসিএল এবং উইপ্রোর মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।

সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ছাড়

স্বল্পমেয়াদি নিয়োগে আসা ভারতীয় পেশাদারদের তিন বছর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সামাজিক নিরাপত্তা অবদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এতে করে ৪০ বিলিয়ন টাকা (৪৬২.৮৮ মিলিয়ন ডলার) সাশ্রয় হবে বলে অনুমান।

যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যচুক্তিতে অর্জন

বিশাল ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার

যুক্তরাজ্যের ৯০% রপ্তানি পণ্য ভারতে সুবিধাজনক শুল্কে প্রবেশ করতে পারবে, যার মধ্যে ৮৫% পণ্য দশ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত হয়ে যাবে। ব্রিটিশ পণ্যের উপর ভারতে গড় শুল্ক ১৫% থেকে কমে ৩% হয়ে যাবে।

বিলাসবহুল পণ্যে বিশেষ সুবিধা

স্কচ হুইস্কির উপর শুল্ক তাৎক্ষণিকভাবে ১৫০% থেকে ৭৫%-এ নেমে আসবে এবং দশ বছরে তা ৪০%-এ পৌঁছাবে। এটি যুক্তরাজ্যের জন্য একটি বিশাল সুবিধা, কারণ ভারত হুইস্কির জন্য একটি ক্রমবর্ধমান বাজার।

ইলেকট্রিক গাড়ির শুল্ক ১১০% থেকে কমে ১০%-এ নেমে আসবে কোটার মধ্যে। কসমেটিক্স, চকোলেট, বিস্কুট, ভেড়ার মাংস, স্যামন মাছ, কোমল পানীয় এবং চিকিৎসা সরঞ্জামও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে।

সেবা খাতে প্রসার

যুক্তরাজ্যের সেবা খাত ৬০,০০০ ভারতীয় পেশাদার পাবে, যারা ইঞ্জিনিয়ারিং ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করবে। আর্থিক সেবায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর সমান আচরণ পাবে।

সরকারি ক্রয়ে অংশগ্রহণ

ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ২,০০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের অ-সংবেদনশীল ভারতীয় সরকারি টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে। বছরে প্রায় ৪০,০০০ টেন্ডারে প্রবেশাধিকার পাবে তারা।

দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রভাব

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি

এই বাণিজ্যচুক্তিতে ২০৪০ সাল নাগাদ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বছরে অতিরিক্ত ২৫.৫ বিলিয়ন পাউন্ড (৩৪ বিলিয়ন ডলার) বৃদ্ধি পাবে। ভারতে যুক্তরাজ্যের রপ্তানি দীর্ঘমেয়াদে প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পাবে, যা ২০৪০ সালের অভিক্ষেপ অনুযায়ী অতিরিক্ত ১৫.৭ বিলিয়ন পাউন্ডের সমান।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি

যুক্তরাজ্যে ২,০০০-এর বেশি নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে এবং বেতন বৃদ্ধি হবে ২.২ বিলিয়ন পাউন্ড। ভারতের শ্রম-নিবিড় খাতগুলোতে, বিশেষত টেক্সটাইল ও চামড়া শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

বিনিয়োগের নতুন ধারা

২৬টি যুক্তরাজ্যের কোম্পানি ভারতে নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ চালু করবে। অন্যদিকে ভারতীয় কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করার অঙ্গীকার করেছে।

ঋষি সুনকের পতন: ভারত-ইউনাইটেড কিংডম সম্পর্কের নতুন অধ্যায়?

পরিবেশ ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা

যুক্তরাজ্য ভারতের সৌর, হাইড্রোজেন, ব্যাটারি প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রিক গাড়ির অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে। এটি ভারতের পরিচ্ছন্ন জ্যালানি বাজারে যুক্তরাজ্যের কৌশলগত প্রবেশের পথ তৈরি করবে।

ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উভয় দেশ কাগজবিহীন কাস্টমস পদ্ধতি এবং ইলেকট্রনিক প্রমাণীকরণ সমর্থন করবে। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পণ্য ছাড়করণের অঙ্গীকার রয়েছে।

ভোক্তাদের জন্য সুবিধা

এই বাণিজ্যচুক্তিতে উভয় দেশের ভোক্তারা সরাসরি উপকৃত হবেন। ভারতীয় ভোক্তারা স্কচ হুইস্কি, ইলেকট্রিক গাড়ি, চকোলেট এবং কসমেটিক্স আরো সাশ্রয়ী দামে পাবেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ভোক্তারা ভারতীয় টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অলঙ্কার কম দামে কিনতে পারবেন।

উভয় পক্ষের ভোক্তারা আরো বেশি পছন্দ এবং কম দামের সুবিধা পাবেন। এই চুক্তি কেবল বাণিজ্য নয়, বরং দুটি গতিশীল অর্থনীতির মধ্যে ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত সহযোগিতার ভিত্তি তৈরি করেছে।

ভারত-যুক্তরাজ্য বাণিজ্যচুক্তিতে উভয় দেশই গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা অর্জন করেছে। ভারত পেয়েছে ৯৯% রপ্তানি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যুক্তরাজ্যও ভারতের বিশাল বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার এবং শুল্ক সুবিধা পেয়েছে। এই চুক্তি শুধু একটি বাণিজ্যিক সমঝোতা নয়, বরং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্বের সূচনা করেছে। আপনার মতামত জানান এবং অন্যদের সাথে এই গুরুত্वপূর্ণ তথ্য শেয়ার করুন।

About Author
Chanchal Sen

চঞ্চল সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক। তিনি একজন অভিজ্ঞ লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি পলিটিক্স নিয়ে লেখালিখিতে পারদর্শী। চঞ্চলের লেখায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গভীর বিশ্লেষণ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন পাঠকদের মুগ্ধ করে। তার নিবন্ধ এবং মতামতমূলক লেখা বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্লেষণধর্মিতার কারণে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। চঞ্চল সেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর গবেষণা তাকে রাজনৈতিক সাংবাদিকতার জগতে একটি স্বতন্ত্র স্থান প্রদান করেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠকদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং সমাজে পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন।