History of fountain pen invention: ফাউন্টেন পেন আবিষ্কারের ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর এবং বিতর্কিত। এই অসাধারণ লেখনী যন্ত্রটি আসলে কে আবিষ্কার করেছিলেন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার ও বিকাশের পেছনে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অবদান রয়েছে।
রোমানীয় আবিষ্কারক পেত্রাচে পোয়েনারু (Petrache Poenaru) কে অনেকে ফাউন্টেন পেনের প্রথম আবিষ্কারক হিসেবে মনে করেন। তিনি ১৮২৭ সালের ২৫ মে ফ্রান্সে ফাউন্টেন পেনের জন্য প্রথম পেটেন্ট লাভ করেন। পোয়েনারুর ডিজাইনে একটি বড় রাজহাঁসের পালক থেকে তৈরি ব্যারেল ব্যবহার করা হয়েছিল, যা কালির ধারক হিসেবে কাজ করত।তবে আধুনিক ফাউন্টেন পেনের জনক হিসেবে আমেরিকান আবিষ্কারক লুইস ওয়াটারম্যানকে বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৮৮৪ সালে একটি অত্যন্ত কার্যকর ফাউন্টেন পেনের পেটেন্ট পান, যা কালি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যাপিলারি অ্যাকশন ব্যবহার করেছিল। এটি ফাউন্টেন পেনের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।এর আগে, ১৮০৯ সালে ইংল্যান্ডে ফ্রেডরিক ফলশ নামে একজন আবিষ্কারক ফাউন্টেন পেনের জন্য প্রথম পরিচিত পেটেন্ট দাখিল করেন। এটি ফাউন্টেন পেনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার ও বিকাশের পেছনে অনেক কারণ ছিল।
ভ্রমণ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন অজানাকে জানতে
ভ্রমণ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন অজানাকে জানতে
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ লেখার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করে আসছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাসে লেখার জন্য রিড পেন ব্যবহার করত। পরবর্তীতে পালক কলম বা কুইল পেন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।কিন্তু এসব লেখনী যন্ত্রের একটা বড় সমস্যা ছিল – প্রতিবার লেখার জন্য কালিতে ডুবিয়ে নিতে হত। এটি সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ ছিল। তাই একটি এমন পেনের প্রয়োজন ছিল, যা নিজের মধ্যেই কালি ধারণ করতে পারে এবং সহজে লেখা যায়। এই চাহিদা থেকেই ফাউন্টেন পেনের জন্ম হয়।পেত্রাচে পোয়েনারু ছিলেন একজন প্রতিভাবান রোমানীয় আবিষ্কারক, প্রকৌশলী ও গণিতবিদ। তিনি ১৭৯৯ সালে ওয়ালাচিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। পোয়েনারু শুধু বৈজ্ঞানিক নন, তিনি রাজনীতি ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি জাতীয় জাদুঘর ও উদ্ভিদ উদ্যানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
পোয়েনারু যখন প্যারিসে পড়াশোনা করছিলেন, তখন তিনি একটি সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিনিয়ত নোট নেওয়ার জন্য বারবার কালিতে পেন ডোবানো তার কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হত। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই তিনি ফাউন্টেন পেন আবিষ্কারের চিন্তা করেন।পোয়েনারুর আবিষ্কৃত ফাউন্টেন পেনটি ছিল অত্যন্ত অভিনব। তিনি একটি বড় রাজহাঁসের পালক ব্যবহার করে পেনের ব্যারেল তৈরি করেছিলেন। এই ব্যারেলটি কালির ধারক হিসেবে কাজ করত। ফলে বারবার কালিতে ডোবানোর প্রয়োজন পড়ত না।১৮২৭ সালের ২৫ মে পোয়েনারু তার এই আবিষ্কারের জন্য ফরাসি সরকারের কাছ থেকে পেটেন্ট লাভ করেন। এটিকে বিশ্বের প্রথম ফাউন্টেন পেন পেটেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।পোয়েনারুর পর ফাউন্টেন পেনের ক্ষেত্রে আরও অনেক উন্নয়ন হয়েছিল।
১৮৮০ এর দশকে আমেরিকান আবিষ্কারক লুইস ওয়াটারম্যান একটি বিপ্লবাত্মক ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার করেন। এই পেনে ক্যাপিলারি ফিড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল, যা কালি লিক হওয়া রোধ করত।ওয়াটারম্যানের আবিষ্কার ফাউন্টেন পেনের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। তার ডিজাইন ও কার্যকারিতার উন্নয়নের কারণে অনেকে তাকেই আধুনিক ফাউন্টেন পেনের জনক হিসেবে বিবেচনা করেন।ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার ও বিকাশের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৬৩৬ সালে জার্মান আবিষ্কারক ড্যানিয়েল শ্বেন্টার প্রথম ফাউন্টেন পেনের ধারণা দেন। তিনি দুটি পালক কলম একসাথে জুড়ে একটি পেন তৈরির কথা বলেন, যেখানে একটি পালক অন্যটির ভিতরে থাকবে এবং কালির ধারক হিসেবে কাজ করবে।
১৮২০ সালের দিকে ডিপ পেন আবিষ্কৃত হয়। এতে ধাতব নিব ব্যবহার করা হত, যা আধুনিক ফাউন্টেন পেনের মতই ক্যাপিলারি চ্যানেল ব্যবহার করত। তবে এতে বারবার কালিতে ডোবাতে হত।১৮২৭ সালে পোয়েনারুর পেটেন্টের পর ফাউন্টেন পেনের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি হতে থাকে। ১৮৫০ এর দশকে ইরিডিয়াম টিপযুক্ত সোনার নিব, হার্ড রাবার ও সহজে প্রবাহমান কালির আবিষ্কার ফাউন্টেন পেনকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।১৮৮০ এর দশকে ওয়াটারম্যান প্রথম ব্যবহারযোগ্য ফাউন্টেন পেনের পেটেন্ট পান এবং এর উৎপাদনে প্রাধান্য বিস্তার করেন। ১৮৯৫ সালে পার্কার কোম্পানি “লাকি কার্ভ” ফিড সিস্টেম চালু করে, যা দশকের পর দশক ধরে ব্যবহৃত হয়েছিল।১৯০৭ সালে শেফার সেলফ-ফিলিং পেন আবিষ্কার করেন। এতে কালি ভরার জন্য আর ড্রপার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ত না।
১৯২১ সালে পার্কার ডুওফোল্ড নামে প্রথম নির্ভরযোগ্য ফাউন্টেন পেন বাজারে আনে।ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার লেখার জগতে এক বিপ্লব এনেছিল। এর ফলে লেখা হয়ে উঠেছিল আরও সহজ, দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্ন। শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য – সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়েছিল।বর্তমানে যদিও বলপয়েন্ট পেন ও ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বেড়েছে, তবুও ফাউন্টেন পেনের চাহিদা কমেনি। অনেকেই এখনও এর স্বতন্ত্র লেখার অনুভূতি ও সৌন্দর্যের জন্য ফাউন্টেন পেন পছন্দ করেন। বিশেষ করে হস্তাক্ষর উন্নয়ন, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফাউন্টেন পেন এখনও অপরিহার্য।ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার ও বিকাশের এই দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের দেখায় যে, মানুষের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতা কীভাবে একটি সাধারণ সমস্যার সমাধান করতে পারে। পেত্রাচে পোয়েনারু, লুইস ওয়াটারম্যান সহ অনেক আবিষ্কারকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজ আমরা একটি অত্যন্ত কার্যকর ও সুন্দর লেখনী যন্ত্র পেয়েছি।
ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার শুধু লেখার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি শিল্প মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অনেক শিল্পী ফাউন্টেন পেন দিয়ে অসাধারণ চিত্রকর্ম তৈরি করেন। এছাড়া ক্যালিগ্রাফি বা সুন্দর হস্তাক্ষর চর্চার জন্য ফাউন্টেন পেন অত্যন্ত জনপ্রিয়।ফাউন্টেন পেনের বাজার এখনও বেশ বড়। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ফাউন্টেন পেনের বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৯২৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২৭ সাল নাগাদ এই বাজার মূল্য ১.২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।বর্তমানে মন্টব্লাঁ, পার্কার, ওয়াটারম্যান, শেফার, লামি প্রভৃতি ব্র্যান্ড বিশ্বব্যাপী ফাউন্টেন পেন বাজারে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এসব কোম্পানি নিয়ত নতুন নতুন ডিজাইন ও প্রযুক্তি নিয়ে এসে ফাউন্টেন পেনকে আরও আকর্ষণীয় ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে।ফাউন্টেন পেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে শঙ্কিত।
ডিজিটাল যুগে হাতে লেখার প্রবণতা কমে যাওয়ায় ফাউন্টেন পেনের চাহিদা কমে যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফাউন্টেন পেনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য এটিকে টিকিয়ে রাখবে।বরং ডিজিটাল যুগে ফাউন্টেন পেন একটি বিলাস দ্রব্যে পরিণত হতে পারে। অনেকেই ডিজিটাল ডিভাইসের পাশাপাশি বিশেষ কাজের জন্য দামী ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। এছাড়া সংগ্রাহকদের কাছেও ফাউন্টেন পেন একটি প্রিয় আইটেম।ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার ও বিকাশের এই অসাধারণ কাহিনী আমাদের দেখায় যে, মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি কীভাবে একটি সাধারণ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এই ছোট্ট লেখনী যন্ত্রটি আজ পর্যন্ত মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ফাউন্টেন পেনের ইতিহাস শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কাহিনী নয়, এটি মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি প্রতীক। লেখার মাধ্যমে জ্ঞান ও ভাবনার বিনিময় মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ফাউন্টেন পেন সেই অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।আজ যখন আমরা স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে টাইপ করি, তখনও অনেকে ফাউন্টেন পেন হাতে নিয়ে লেখার আনন্দ উপভোগ করেন। এটি প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির মধ্যেও কিছু জিনিস চিরন্তন থেকে যায়।
ফাউন্টেন পেন তারই একটি উদাহরণ।শেষ পর্যন্ত বলা যায়, ফাউন্টেন পেনের আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি শুধু লেখার একটি যন্ত্র নয়, বরং মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির একটি প্রতীক। আগামী দিনেও ফাউন্টেন পেন হয়তো নতুন নতুন রূপে আমাদের মুগ্ধ করতে থাকবে।