মাসুদ আজহার পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মুহম্মদের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান, যিনি ভারতে বেশ কয়েকটি বড় সন্ত্রাসী হামলার পিছনে মূল মস্তিষ্ক। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা ‘বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত এই ব্যক্তি ২০০১ সালের সংসদ হামলা, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী বোমা হামলা সহ বেশ কয়েকটি মারাত্মক ঘটনার জন্য দায়ী। সম্প্রতি ভারতের ‘অপারেশন সিন্দূর’-এর ফলে আজহারের পরিবারের ১০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
মাসুদ আজহার: প্রারম্ভিক জীবন ও জঙ্গি কার্যকলাপের সূচনা
মোহাম্মদ মাসুদ আজহার আলভি ১৯৬৮ সালের ১০ জুলাই পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। কিছু সূত্র অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৭ আগস্ট, ১৯৬৮। তিনি এগারো ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাবা আল্লাহ বখশ শাব্বির একজন সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং দেওবন্দি ধারার একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন। পরিবারটি ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম চালাত।
মাসুদ আজহার মূলধারার স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর জামিয়া উলুম ইসলামিক স্কুলে ভর্তি হন, যেখান থেকে তিনি ১৯৮৯ সালে আলিম হিসেবে পাস করেন এবং শীঘ্রই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এই মাদ্রাসা হারকাত-উল-আনসার সংগঠনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিল এবং আজহারকে আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়। যদিও তিনি কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে ব্যর্থ হন, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে যোগ দেন এবং আহত হওয়ার পর অবসর নেন।
জঙ্গি কার্যকলাপের শুরু
আফগানিস্তান থেকে ফেরার পর, আজহারকে হারকাত-উল-আনসারের অনুপ্রেরণা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। তাকে উর্দু ভাষার ম্যাগাজিন ‘সাদ-ই-মুজাহিদিন’ এবং আরবি ভাষার ‘সাওতে কাশ্মীর’ পত্রিকার সম্পাদকীয় দায়িত্বও দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আজহার হারকাত-উল-আনসারের সাধারণ সম্পাদক হন এবং রিক্রুটমেন্ট, তহবিল সংগ্রহ এবং প্যান-ইসলামিজমের বার্তা ছড়াতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্থান ভ্রমণ করেন।
ভারতে গ্রেপ্তার এবং সন্ত্রাসবাদী বিনিময়
১৯৯৪ সালের শুরুতে আজহার ভুয়া পরিচয় নিয়ে শ্রীনগরে যান। ভারত তাকে ফেব্রুয়ারি মাসে আনন্তনাগের কাছে খানাবাল থেকে গ্রেফতার করে এবং হারকাত-উল-জিহাদ আল-ইসলামি এবং হারকাত-উল-মুজাহিদিনের সাথে তার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য কারাগারে পাঠায়। তাকে প্রথমে শ্রীনগরের বাদামি বাগ ক্যান্টনমেন্টে, পরে দিল্লির তিহার জেলে এবং শেষে জম্মুর কোট বালওয়াল জেলে রাখা হয়।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে, জম্মু ও কাশ্মীরে ছয় বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করা হয়। অপহরণকারীরা, যারা নিজেদেরকে আল-ফারান (হারকাত-উল-মুজাহিদিনের একটি ছদ্মনাম) বলে পরিচয় দেয়, তাদের দাবির মধ্যে ছিল মাসুদ আজহারকে মুক্তি দেওয়া। অপহৃতদের একজন পালাতে সক্ষম হন, অন্য একজনকে আগস্টে মাথা-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। বাকিদের আর কখনও দেখা যায়নি।
আইসি-৮১৪ বিমান হাইজ্যাক এবং মুক্তি
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে, পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা ভারতীয় বিমান আইসি-৮১৪ হাইজ্যাক করে, যা কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি যাচ্ছিল। হাইজ্যাকাররা দাবি করে যে তাদের তিন জন সঙ্গীকে মুক্ত করা হোক – মাসুদ আজহার, আহমেদ ওমার সাঈদ শেখ এবং মুস্তাক আহমেদ জারগার। এটি ছিল মাসুদ আজহারের ছোট ভাই আব্দুল রউফ আজহারের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি অভিযান। যাত্রীদের জীবন বাঁচাতে, ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত আজহার সহ তিন সন্ত্রাসবাদীকে মুক্তি দেয়।
জইশ-ই-মুহম্মদের প্রতিষ্ঠা
মুক্ত হওয়ার পর, আজহার জইশ-ই-মুহম্মদ (জেইএম) নামে একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন গঠন করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই), আফগানিস্তানের তালিবান শাসন, ওসামা বিন লাদেন এবং পাকিস্তান ভিত্তিক বেশ কয়েকটি সুন্নি সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সহায়তা পান। জইশ-ই-মুহম্মদ আজহারের পরিবার দ্বারা পারিবারিক ব্যবসার মতো পরিচালিত হয়। জামিয়া বিনোরিয়া মাদ্রাসা জেইএমকে আফগান তালিবানের সাথে সংযুক্ত করে।
ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা
আজহারের নেতৃত্বে, জইশ-ই-মুহম্মদ ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মারাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
২০০১ সালের ভারতীয় সংসদ হামলা
১৩ ডিসেম্বর, ২০০১-এ, লস্কর-ই-তাইবা এবং জইশ-ই-মুহম্মদের সদস্যরা নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংসদে হামলা চালায়। এই হামলায় পাঁচ জন সন্ত্রাসবাদী, ছয় জন দিল্লি পুলিশ কর্মী, দুজন সংসদ নিরাপত্তা সেবা কর্মী এবং একজন মালী – মোট ১৪ জন নিহত হন। হামলাটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে, যার ফলে ২০০১-০২ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের উস্কানি দেওয়া হয়।
২০১৬ সালের পাঠানকোট বিমান ঘাঁটি হামলা
২০১৬ সালে, জইশ-ই-মুহম্মদের সন্ত্রাসবাদীরা পাঞ্জাবের পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এই হামলায় সাত ভারতীয় সেনাকর্মী এবং এক নাগরিক নিহত হন।
২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী বোমা হামলা
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এ, জইশ-ই-মুহম্মদের একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় একটি সিআরপিএফ কনভয়ে হামলা চালায়, যাতে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন। এই হামলার পর, ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বালাকোটে জইশের একটি শিবিরে বায়ুহামলা চালায়। এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর প্রথম বায়ু আক্রমণ ছিল।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে স্বীকৃতি
অনেক বছর ধরে, পাকিস্তান আজহারের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখিয়েছে, যদিও তার পাকিস্তানে উপস্থিতির বিষয়ে শক্তিশালী প্রমাণ ছিল। তাকে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারত বহু বছর ধরে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কমিটির অধীনে আজহারকে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী হিসেবে মনোনীত করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পাকিস্তানের চির-বন্ধু চীনের বাধার মুখে পড়েছে।
অবশেষে, ১ মে, ২০১৯-এ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আজহারকে আল-কায়দার সাথে সম্পর্কিত হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়, যিনি “জইশ-ই-মুহম্মদের নামে, পক্ষে, বা সমর্থনে কার্য বা কার্যকলাপ অর্থায়ন, পরিকল্পনা, সহজীকরণ, প্রস্তুতি বা সংঘটন” এবং “অস্ত্র ও সংশ্লিষ্ট সামগ্রী সরবরাহ, বিক্রয় বা স্থানান্তর” এ অংশগ্রহণ করেছেন।
অপারেশন সিন্দূর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা
সম্প্রতি, ভারত পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) জঙ্গি আস্তানাগুলিতে “অপারেশন সিন্দূর” নামে একটি প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযান চালায়। এই অভিযানটি পাহালগামে ২৬ জনের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পরিচালিত হয়।
পাকিস্তানের পাঞ্জাবের বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত মারকাজ সুবহান আল্লাহ (জইশের একটি প্রশিক্ষণ ঘাঁটি) সহ ভারতীয় বাহিনী নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে এবং ধ্বংস করে। এই অভিযানে মাসুদ আজহারের ১০ জন পরিবারের সদস্য এবং চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিহত হন বলে দাবি করা হয়েছে।
মাসুদ আজহারের প্রতিক্রিয়া
আজহার একটি বিবৃতিতে তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমার পরিবারের দশজন সদস্য আজ রাতে একসাথে এই সুখ লাভ করেছেন… পাঁচজন নিষ্পাপ শিশু, আমার বড় বোন, তার সম্মানিত স্বামী। আমার বিদ্বান ফাজিল ভাগ্নে (ভাতিজা) ও তার স্ত্রী এবং আমার প্রিয় বিদ্বান ফাজিলাহ (ভাগ্নি)… আমার প্রিয় ভাই হুজাইফাহ ও তার মা। আরও দুজন প্রিয় সঙ্গী,” তিনি বলেন যে যারা নিহত হয়েছেন তারা “আল্লাহর অতিথি” হয়ে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, তার “না অনুশোচনা, না হতাশা” আছে। “বরং, আমার হৃদয়ে বারবার আসে যে আমিও এই চৌদ্দ সদস্যের সুখী কারভানে যোগ দিতাম।”
মাসুদ আজহার কেন ভারতের সর্বাধিক খোঁজা ব্যক্তি?
মাসুদ আজহার বিভিন্ন কারণে ভারতের সবচেয়ে খোঁজা সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে একজন:
- ভারতীয় সংসদে হামলা: ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে হামলার পরিকল্পনা ও নির্দেশনার জন্য তিনি দায়ী। এই হামলা ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধের প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
- পুলওয়ামা হামলা: তার সংগঠন ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ৪০ জওয়ানকে হত্যা করে।
- পাঠানকোট হামলা: ২০১৬ সালে পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালানোর জন্য তার সংগঠন দায়ী।
- আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী: তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
- সন্ত্রাসবাদী সংগঠন সৃষ্টি: তিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জইশ-ই-মুহম্মদের প্রতিষ্ঠাতা, যা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সাথে জড়িত।
- আইএসআই ও তালিবানের সাথে সংযোগ: তার সংগঠন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং আফগান তালিবানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে।
- ভারতে মুক্তি পাওয়ার পর সন্ত্রাসবাদ জারি রাখা: তাকে ভারত থেকে মুক্তি দেওয়ার পর, তিনি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ জারি রাখেন এবং ভারতকে লক্ষ্য করে আরও বড় ও মারাত্মক হামলার পরিকল্পনা করেন।
উপসংহার
মাসুদ আজহার, জইশ-ই-মুহম্মদের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান, ভারতে অনেকগুলি মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী। তার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায়ই সীমাবদ্ধ নয়; বিবিসি নিউজ তাকে “ব্রিটেনে জিহাদ নিয়ে আসা ব্যক্তি” হিসাবে বর্ণনা করেছে। ২০১৯ সালের ১ মে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও, তিনি পাকিস্তানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে থাকেন।
সম্প্রতি ভারতের অপারেশন সিন্দূরে তার পরিবারের দশ সদস্য নিহত হলেও, আজহার নিজে এখনও মুক্ত আছেন এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের পক্ষে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে, তাকে ধরা এবং বিচারের মুখোমুখি করা একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসাবেই রয়ে গেছে। পুলওয়ামা হামলা, সংসদ হামলা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মূল মস্তিষ্ক হিসাবে, মাসুদ আজহার ভারতের সর্বাধিক খোঁজা সন্ত্রাসবাদীদের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছেন।