whole body itching causes: আপনি কি রাতে ঘুমাতে পারেন না সারা শরীর জুড়ে চুলকানির কারণে? অথবা দিনের বেলা কাজকর্মে মনোযোগ দিতে পারেন না এই অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্য? সারা গায়ে চুলকানির কারণ বুঝতে পারলেই আপনি সঠিক চিকিৎসা নিতে পারবেন এবং এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই অবস্থাকে বলা হয় ‘প্রুরিটাস’। বিশ্বের প্রায় ১৭% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো সময় সারা গায়ে চুলকানির কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। আজকের এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানব কীভাবে বিভিন্ন রোগ, পরিবেশগত কারণ এবং শারীরিক অবস্থা আপনার সারা শরীরে চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে।
ত্বকের সমস্যাজনিত সারা গায়ে চুলকানির কারণ
শুষ্ক ত্বক – সবচেয়ে সাধারণ কারণ
শুষ্ক ত্বক বা ‘জেরোসিস’ হলো সারা গায়ে চুলকানির কারণ এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান। শীতকালে এই সমস্যা আরো বেড়ে যায় কারণ বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল কমে যায়, ফলে চুলকানি বৃদ্ধি পায়।
শুষ্ক ত্বকের লক্ষণগুলো হলো:
- ত্বকে আঁশের মতো দাগ
- রুক্ষতা এবং খসখসে ভাব
- কখনো কখনো ত্বক ফেটে যাওয়া
- সাদা গুঁড়ার মতো উঠে আসা
একজিমা ও অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস
একজিমা একটি দীর্ঘমেয়াদী ত্বকের রোগ যা তীব্র চুলকানি সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত পরিবারের ইতিহাস থাকলে বেশি হয়, বিশেষত যাদের অ্যাজমা বা অ্যালার্জির সমস্যা আছে। একজিমায় ত্বকে লাল, আঁশযুক্ত দাগ দেখা যায় যা প্রচণ্ড চুলকায়।
সোরিয়াসিস এবং অন্যান্য ত্বকের রোগ
সোরিয়াসিস একটি অটোইমিউন রোগ যাতে ত্বকে পুরু, লাল এবং রূপালী রঙের আঁশ তৈরি হয়। এই আঁশগুলো তীব্র চুলকানি সৃষ্টি করে এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ রোগজনিত সারা গায়ে চুলকানির কারণ
কিডনি রোগ ও ইউরেমিয়া
দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগে আক্রান্ত ৪০-৯০% রোগীর মধ্যে চুলকানির সমস্যা দেখা যায়। বিশেষত যারা ডায়ালাইসিস নেন তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমে যায় যা চুলকানি সৃষ্টি করে।
লিভারের রোগ ও কলেস্টেসিস
লিভারের যেকোনো সমস্যা, বিশেষত কলেস্টেসিস (পিত্তের প্রবাহে বাধা) সারা গায়ে চুলকানির কারণ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে:
- প্রাইমারি বিলিয়ারি কলাঙ্গাইটিস
- ভাইরাল হেপাটাইটিস
- লিভার সিরোসিস
- গর্ভকালীন কলেস্টেসিস
লিভারজনিত চুলকানির বিশেষত্ব হলো এটি প্রথমে হাতের তালু ও পায়ের তলায় শুরু হয় পরে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
ডায়াবেটিস ও হরমোনের সমস্যা
ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তের গ্লুকোজের কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং চুলকানি হয়। থাইরয়েডের সমস্যা, বিশেষত হাইপারথাইরয়েডিজমে ৪-১১% রোগীর চুলকানি দেখা যায়।
ক্যান্সার ও রক্তের রোগ
কিছু ক্যান্সার, বিশেষত রক্তের ক্যান্সার (লিম্ফোমা, লিউকেমিয়া) চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া আয়রনের অভাব জনিত রক্তস্বল্পতাতেও চুলকানি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে আয়রনের অভাবে ১৩.৬% পুরুষ এবং ৭.৪% নারীর চুলকানির সমস্যা হয়।
সংক্রমণ ও পরজীবীজনিত সারা গায়ে চুলকানির কারণ
ভাইরাল ও ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ
এইচআইভি সংক্রমণে আক্রান্ত ১৩-৪৫% রোগীর দীর্ঘমেয়াদী চুলকানির সমস্যা হয়। এইচআইভি পজিটিভ রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ত্বকের রোগ যেমন লাইকেন সিমপ্লেক্স ক্রনিকাস, স্ক্যাবিজ, সেবোরিক ডার্মাটাইটিস ইত্যাদি বেশি হয় যা তীব্র চুলকানি সৃষ্টি করে।
স্ক্যাবিজ ও অন্যান্য পরজীবী
স্ক্যাবিজ হলো ছোট মাইট (পরজীবী) দ্বারা সৃষ্ট রোগ যা তীব্র চুলকানি সৃষ্টি করে। এটি সাধারণত আঙুলের ফাঁকে, কব্জিতে, বগলে এবং কুঁচকিতে লাল দাগ ও সুড়ঙ্গের মতো চিহ্ন তৈরি করে।
ওষুধ ও বাহ্যিক কারণে সারা গায়ে চুলকানির কারণ
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অনেক ওষুধই চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ইমিউন চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর (ক্যান্সারের ওষুধ)
- ওপিয়েড ব্যথানাশক
- ক্লোরোকুইন ও অন্যান্য ম্যালেরিয়ার ওষুধ
- বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের কেমোথেরাপি
অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন
খাবারের অ্যালার্জি, রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শ, বা নির্দিষ্ট ফেব্রিক্সের কারণেও সারা গায়ে চুলকানির কারণ হতে পারে। সাধারণ অ্যালার্জেনের মধ্যে রয়েছে দুধ, ডিম, বাদাম, মাছ, গম ইত্যাদি।
স্নায়ুগত ও মানসিক সারা গায়ে চুলকানির কারণ
নিউরোপ্যাথিক চুলকানি
স্নায়ুর সমস্যার কারণে মোট চুলকানির ৮% ক্ষেত্রে নিউরোপ্যাথিক চুলকানি হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- ব্র্যাকিওরেডিয়াল প্রুরিটাস (বাহুতে চুলকানি)
- নোটালজিয়া প্যারেস্থেটিকা (পিঠে চুলকানি)
- মাথার ত্বকে অস্বস্তি
মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা
দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্ণতার কারণেও চুলকানি হতে পারে। স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ত্বকের সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়।
গর্ভাবস্থা ও বয়সজনিত সারা গায়ে চুলকানির কারণ
গর্ভকালীন চুলকানি
গর্ভাবস্থায় চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত এটি নিরীহ হলেও কখনো কখনো ইনট্রাহেপাটিক কলেস্টেসিস অফ প্রেগনেন্সি (আইসিপি) নামক গুরুতর অবস্থার ইঙ্গিত হতে পারে। এই ক্ষেত্রে গর্ভকালীন শেষ ৪ মাসে সারা শরীরে, বিশেষত হাতের তালু ও পায়ের তলায় তীব্র চুলকানি হয়।
রজোনিবৃত্তি পরবর্তী চুলকানি
রজোনিবৃত্তির পর হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় এবং চুলকানি বৃদ্ধি পায়। সাধারণত সময়ের সাথে এই সমস্যা কমে যায়।
পুষ্টির অভাব ও ভিটামিনের ঘাটতি
বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতিও চুলকানির কারণ হতে পারে:
- ভিটামিন ডি এর অভাব
- ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি
- আয়রনের অভাব
- জিঙ্কের অভাব
গবেষণায় দেখা গেছে যে এসব পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণ করলে চুলকানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:
- ৩ দিনের বেশি চুলকানি থাকলে
- চুলকানি দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করলে
- সারা শরীরে তীব্র চুলকানি হলে
- জ্বর, ওজন কমা বা অন্য গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে
- ৬ সপ্তাহের বেশি চুলকানি থাকলে
চিকিৎসক রক্ত পরীক্ষা, ত্বকের বায়োপসি এবং প্রয়োজনে ইমেজিং টেস্টের মাধ্যমে সারা গায়ে চুলকানির কারণ নির্ণয় করবেন।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
চুলকানির চিকিৎসা নির্ভর করে এর কারণের উপর:
- অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ
- টপিকাল স্টেরয়েড ক্রিম
- ময়েশ্চারাইজার নিয়মিত ব্যবহার
- ঠান্ডা সেক
- ওটমিল বাথ
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
সারা গায়ে চুলকানির কারণ অনেক বৈচিত্র্যময় এবং কখনো কখনো জটিল। সাধারণ শুষ্ক ত্বক থেকে শুরু করে গুরুতর অভ্যন্তরীণ রোগ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে এই সমস্যা হতে পারে। তাই যদি আপনার চুলকানি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা তীব্র আকার ধারণ করে, তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।মনে রাখবেন, সঠিক নির্ণয় এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে চুলকানির সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর এর জন্য প্রথমেই জানতে হবে আপনার সারা গায়ে চুলকানির কারণ কী।