ভারতের রাজনীতিতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হওয়ার পর, অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাদের বিজয় নিশ্চিত। তবে এইবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে।
ভারতের অর্থনীতি বিজেপির জন্য বরাবরই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মহামারীর পরের সময়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া জটিল ছিল। বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি এবং কৃষকদের সমস্যা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে জিনিসপত্রের দাম বাড়া এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। দেশের অনেক অংশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত ছিল, যা বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতি ভোটারদের আস্থা হ্রাস করে এবং বিজেপির জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা কয়েক মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকার আইনগুলো প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়, তবে এই আন্দোলন বিজেপির ভাবমূর্তিতে গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের কৃষকরা বিজেপির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এই কৃষক আন্দোলনের ফলে গ্রামীণ ভোটারদের মধ্যে সরকারের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ে, যা নির্বাচনে বিজেপির ফলাফলে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলো শক্তিশালীভাবে উঠে আসে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, নবীন পট্টনায়কের বিজেডি, এবং কে. চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই দলগুলো নিজেদের রাজ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং তাদের প্রভাব বিজেপির আসনসংখ্যায় বড় প্রভাব ফেলে। আঞ্চলিক দলগুলোর শক্তিশালী অবস্থান বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে।
বিজেপির ধর্মীয় এবং জাতিগত রাজনীতি তাদের কিছু ভোটারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুসলিম সংখ্যালঘু এবং দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির প্রতি একটি ভয় এবং অবিশ্বাস ছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, যা দেশের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। এই বিভাজনমূলক রাজনীতি অনেক ভোটারকে বিজেপি থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং বিরোধী দলগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন বাড়িয়ে দেয়।
বিরোধী দলগুলো ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে একত্রিত হয়ে শক্তিশালী জোট গঠন করে। কংগ্রেস এবং অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো বিজেপির বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করে এবং ভোটারদের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়। বিরোধী জোটের একতা এবং সংগঠিত প্রচারাভিযান বিজেপির ভোটব্যাংকে বড় ধাক্কা দেয়। এই জোট বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির শক্তিকে দুর্বল করে এবং তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারার পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করেছে। অর্থনৈতিক সমস্যা, কৃষক আন্দোলন, আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান, ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজন এবং বিরোধী জোটের সাফল্য—এই সমস্ত কারণগুলো মিলে বিজেপির বিজয়কে সীমিত করে। এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে ভারতের রাজনীতিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি কঠিন কাজ এবং বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল নির্দেশ করে এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নতুন কৌশল ও পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করায়।